আপনি কি ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয় তা জানতে চাচ্ছেন? এ বিষয়ে আপনি হয়তো বিভিন্ন জায়গায় খোজ খবর নিয়েছেন কিন্তু কোথাও সঠিক বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছেন না। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি একটু মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। তাহলে ডলারের দাম যেভাবে নির্ধারিত হয় সেটা জেনে আপনি উপকৃত হতে পারবেন বলে আমরা শতভাগ আশাবাদী।
কেননা আমরা আজকের এই সম্পূর্ণ আর্টিকেলজুড়ে ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয় সেই সম্পর্কে আলোচনা করার পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিময় হার কি, ডলারের দাম বাড়ে কমে কেন, টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হয় এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তাই অনুরোধক্রমে অবহেলা না করে সম্পূর্ণ পোষ্টটি শুরু থেকে একেবারে শেষ অবদি পড়ুন।
উপস্থাপনা
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য দেশ সৌদি আরবের ১ রিয়াল বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩১.৯০ টাকার সমান। অন্যদিকে আমেরিকান ১ ডলারে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১২০ টাকা পাওয়া যায়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এক দেশের মুদ্রার সাথে অন্য দেশের মুদ্রার পার্থক্য দেখা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক প্রবাসে কর্মরত অবস্থায় রয়েছেন যারা প্রায় প্রতিমাসেই প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আমাদের বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। এছাড়া আমরা অনেক কাজেই বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করি যেমন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, কিংবা বিদেশে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি। এজন্য হয়তো মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আমাদের মাঝে এমন অনেকেই আছেন যারা জানেন না যে আসলে এই ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারন করা হয়। মূলত তাদের সুবিধার কথা ভেবেই আমাদের আজকের এই পোষ্টটি সাজানো হয়েছে। তাহলে চলুন, আর অতিরিক্ত কথা না বাড়িয়ে আজকের আলোচ্য বিষয়ে আলোচনা শুরু করা যাক। তবে আমরা প্রথমে বৈদেশিক বিনিময় হার কি সেই সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নিব।
বৈদেশিক বিনিময় হার কি
কোনো এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশের যে পরিমাণ মুদ্রা কিনতে সক্ষম হয় সে প্রক্রিয়াকেই বৈদেশিক বিনিময় হার বলা হয়। অন্য আরেকভাবে বলতে গেলে, একটি দেশের মুদ্রার মান যত হবে সেই মান অনুযায়ী অন্য দেশের মুদ্রার মান একক অনুসারে নিয়ম অনুযায়ী মুদ্রা বিনিময় করা যায়।
উদাহরণ হিসেবে: আমাদের দেশে যদি ১২০ টাকায় ১ মার্কিন ডলার ক্রয় করতে পারা যায় তাহলে আমরা বলতে পারি যে, ১২০ টাকা সমান ১ মার্কিন ডলার অথবা ১ ডলার সমান প্রায় ১২০ টাকা। এক দেশের মুদ্রা বা কারন্সির সাথে অন্য কোন আলাদা দেশের মুদ্রা বা কারেন্সির মূল্যানুপাতই হচ্ছে বিনিময় হার।
এরূপ লেনদেনে বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কযুক্ত। যে কারণে লেনদেন নিষ্পত্তিতে উভয় দেশের মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া লেনদেন নিষ্পত্তির উপায় নির্ধারণও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এক দেশের মুদ্রাকে অন্যদেশের মুদ্রার মূল্যমানে রূপান্তর কৌশলকে বৈদেশিক বিনিময় বলে।
ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয়
সাধারণত ডলারের দাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে ২ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়; প্রথমটি হচ্ছে হার্ড পেগ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সফট পেগ। হার্ড পেগ পদ্ধত হল মূল সরকার নিজে থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মান ঠিক করে দেয় এবং সেই মোতাবেক লেনদেন করা হয়।
অপরদিকে সফট পেগ পদ্ধতি মূলত বলতে গেলে বৈদেশিক বাজারের উপর ভিত্তি করে মুদ্রা বা কারেন্সি এর মান ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে একটা বিষয় এখানে পরিস্কার বলা যায় যে এটা চাইলে সরকার সফট পেগ পদ্ধতি যথাসম্ভব ব্যবহার করে ডলারের দাম নির্ধারন করে দিতে পারে। এছড়া অনেক দেশ রয়েছে যেখানে হস্তক্ষেপবিহীন মান নির্ধারণ সঠিকভাবে করার জন্য ‘ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট’ ব্যবহার করা হয়।
যার ফলে ডলারের দাম কখনও কখনও একেবারে তলানিতে চলে যায় না বরং আকাশচুম্বী আকার ধারণ করে। মূলত অস্থিতিশীল মুদ্রাবাজারে সমতা আনতে আপদকালীন পদ্ধতি ব্যভার করে ডলারের দাম এইভাবেই নির্ধারিত হয়। তো আশা করছি ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয় তা জানতে পেরেছেন।
ডলারের দাম বাড়ে কমে কেন
যখন কোনও কিছুর চাহিদা বেশি হবে এবং এর পাশাপাশি সেই জিনিসের জোগান কমে যাবে তখন সেই জিনিসের দাম বেশি হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের চাহিদা এখন অনেক বেশি যার ফলে ডলারের দামও দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। মূলত যেসব দেশে আমদানি পরিমাণ বেশি, কিন্তু রপ্তানির পরিমান অনেক কম সেই দেশে আয়ের চেয়ে আমদানি বাবদ বেশি খরচ করে।
ডলারের দাম বেশি হয়ে গেলে আমদানি খরচও বেড়ে যায়। যেমন আমাদের বাংলাদেশের কথা বলি, যদি ডলারের দাম বেড়ে যায় তাহলে আমাদের বেশি খরচে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি করা লাগে। এতে করে ভোজ্য তেল ও খাদ্যশস্যসহ প্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহন খরচটাও বাড়ে।
জ্বালানির জন্য বাড়তি ডলার খরচ করতে হয় বলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির সক্ষমতা কমতে থাকে। এ কারণে আমদানিনির্ভর দেশগুলোয় বিদেশি পণ্য ব্যয়বহুল হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি একটি দেশকে মূল্যস্ফীতির দিকে ঠেলে দেয়। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়।
ঠিক উল্টো হয় রপ্তানির ক্ষেত্রে। যখন আমরা কোনো পন্য দেশের বাহিরে বিক্রি করি, এর বিপরীতে আমরা পেমেন্ট হিসেবে ডলার পাই। তখন আমাদের ডলারের রিজার্ভ বাড়ে। সমস্যার শুরু হয়, চীন সহ আরো কিছু দেশ দীর্ঘদিন তাদের দেশ থেকে সকল প্রকার আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রাখে। যখন তাঁরা বর্ডার খুলে দেয়, তখন ব্যবসায়ীরা পন্য আমদানীর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
এতে করে দেশের বাজারে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। ডলার এর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এবং আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়। যার ফলে ডলার এর দাম বেড়ে যায়।
রেমিটেন্স কম থাকার কারনে দেশের বাজারে ডলারের রিজার্ভ অনেকটা কমে আসে। এটিও ডলারের দাম বাড়ার আরেকটি কারন। করোনা পরবর্তী সংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন। এদিকে কাচামাল সংকটে উৎপাদন এবং রপ্তানি কমে যাওয়ায় আমাদের ডলার আয় কম হয়েছে। এতে বানিজ্য ঘাটতি অনেক বেড়ে গিয়েছে। যার কারনে ডলারের দাম অনেক বেড়েছে। আশা করছি ডলারের দাম বাড়ে কমে কেন তা জানতে পেররেছেন। এবার আসুন, টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হয় তা জেনে নেওয়া যাক।
টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হয়
বর্তমানে বাংলাদেশী অনেক নাগরিক প্রবাসে কর্মরত থাকায় প্রায় প্রতিমাসেই প্রচুর পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে বাংলাদেশে। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ, কিংবা বিদেশে ঘুরতে যাওয়াসহ অনেক কাজেই আমরা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করি। আর তাই মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
কোনো একটি দেশের মুদ্রা অন্য দেশে গিয়ে কত হবে, তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের উপর। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট’ তত্ত্ব। এ তত্ত্বে বলা হয়, কোনো একটি দেশের মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের উপর ভিত্তি করে সে মুদ্রার মান নির্ধারিত হবে। যেমন একটি দেশ যখন অন্য দেশ থেকে কোনো জিনিস আমদানি করে, তখন ঐ জিনিসের মূল্য রপ্তনিকারক দেশের মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।
ধরুন, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০০০ ডলার মূল্যের গুঁড়া দুধ আমদানি করল। এখন মূল্য পরিশোধের সময় বাংলাদেশকে আমেরিকার মুদ্রায় ১০০০ ডলার পরিশোধ করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন হলো, এই ডলার বাংলাদেশ কোথা থেকে পাবে? আমেরিকান কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশকে প্রথমে ঐ ১,০০০ ডলার ক্রয় করতে হবে।
যখন কোনো একটি দেশ অন্য দেশের উপর প্রচুর মাত্রায় আমদানি নির্ভর হয়ে যায়, তখন আমদানিকারক দেশের মুদ্রার মান ক্রমশ কমতে থাকে। আবার যদি উল্টোটি হয়; অর্থাৎ, কোনো দেশ প্রচুর পরিমাণ জিনিস বিদেশে রপ্তানি করে, তাহলে রপ্তানিকারক দেশের মুদ্রার মান ক্রমশ বাড়তে থাকবে। আর এভাবে মুদ্রার চাহিদা ও যোগানের উপর ভিত্তি করে মুদ্রার মান নির্ধারণ করা হয়।
ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য
বর্তমান সময়ে এসে আপডেট তথ্য অনুযায়ী ১ টাকার বিপরীতে ডলার এর মূল্য প্রায় ১৯.৫১ টাকা দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল বলা হচ্ছে, ডলারের বিপরীতে এটি এখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় দর পতন। কিছুদিন আগে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন ডলারের দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে বলেছিলেন আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলার প্রায় ১২০ টাকা করে লেনদেন করা হবে।একই দামে রেমিটেন্সও কেনা হবে।
গত এক বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকার দর পর্যায়ক্রমে কমেই যাচ্ছে। বিভিন্ন পদক্ষেপ অবলম্বন করেও এই দরপতন ঠেকানো যাচ্ছে না। গত বছরের এই সময়ে ১ মার্কিন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল ৯১ টাকা। আর ২০২৪ সালের ১০ অক্টোবর ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৯.৮৫ পয়সা।
এতোদিন ধরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স, আমদানি এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ডলার রেট ছিল। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে একটি শর্ত দেয়া হয়েছিল সেটি হচ্ছে, সবক্ষেত্রে যেন ডলারের রেট একক দর থাকে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মানটা আসলে কিভাবে নির্ধারন করা হবে সেটা মূলত বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। আশা করছি আমি আপনাকে এই বিষয়টি বোঝাতে পেরেছি।
ডলারের দাম নিয়ে লেখকের মতামত
আমরা ইতিমধ্যে ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আশা করছি আপনারা এতক্ষণে আপনার মনে থাকা সকল ধরণের প্রশ্নের উত্তর জানতে পেরেছেন। তবে এছাড়াও ডলারের দাম নিয়ে আপনার কোন মতামত থাকলে তা এই পোষ্টের কমেন্ট বক্সে জানতে একদমই দ্বিধাবোধ করবেন না। আমরা আপনার মতামতের অনুপ্রেরণা জানাতে খুবই আগ্রহী।
আজকের পোষ্ট নিয়ে এই ছিল আমাদের ডলারের দাম কিভাবে নির্ধারিত হয় তা নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়াদি। আপনি যদি এই আর্টিকেলটি শুরু থেকে মনযোগ সহকাড়ে পড়েন তাহলে থাকলে আপনি হয়তো বৈদেশিক বিনিময় হার কি, ডলারের দাম বাড়ে কমে কেন, টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হয়, টাকার মান কিভাবে নির্ধারিত হয় ইত্যাদি বিস্তারিত জেনে গেছেন।