নামাজ মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় ইবাদত। এটা শুধু দায়িত্ব নয়—প্রভুর সাথে হৃদয়ের একান্ত সংযোগ। নামাজ শেষে যদি কিছু বিশেষ আমল করা যায়, তাহলে মনে আসে গভীর প্রশান্তি। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও আমল করতেন, যা আমাদের জন্য দিকনির্দেশনা।
আপনি কি জানেন—ফরজ নামাজের পর নবীজির নিয়মিত আমল কী ছিল? আর আমরা কী কী আমল করতে পারি? চলুন, জেনে নিই সেই সুন্দর কিছু মাসনূন আমল ও দোয়া— যা আপনার প্রতিদিনের নামাজকে আরও অর্থবহ করে তুলবে। ইনশাআল্লাহ
ফরজ নামাজের পর নবীজির আমল
নবী করিম মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সা.) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাঁর ইবাদত, আখলাক, সামাজিকতা, ও বিশেষ করে নামাজের পূর্ব ও পরবর্তী আমলসমূহ মুসলিমদের জন্য পথনির্দেশক। ফরজ নামাজের পর নবীজির আমলগুলো আমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করতে ও আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এই লেখায় আমরা নবীজির ফরজ নামাজ-পরবর্তী আমলসমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো।
দোজাহানের বাদশা, রহমতে আলম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পড়তেন কিছু বিশেষ দোয়া—সংখ্যায় ১২টি। এই দোয়াগুলো যেমন ছোট, তেমনি সহজ ও অর্থবহ। প্রতিটি দোয়া আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর এক একটি সেতুবন্ধ।
নিচে টেবিল আকারে দেওয়া হলো সেই মূল্যবান দোয়াগুলো — আরবি ও বাংলা অনুবাদসহ, যেন সহজেই মুখস্থ ও আমলে আনা যায়।
ক্রমিক | আরবি | বাংলা উচ্চারণ | বার |
০১ | “أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ | আস্তাগফিরুল্লাহ। | ৩ বার |
০২ | ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺃَﻧْﺖَ ﺍﻟﺴَّﻼَﻡُ، ﻭَﻣِﻨْﻚَ ﺍﻟﺴَّﻼَﻡُ، ﺗَﺒَﺎﺭَﻛْﺖَ ﻳَﺎ ﺫَﺍ ﺍﻟْﺠَﻼَﻝِ ﻭَﺍﻟْﺈِﻛْﺮَﺍﻡِ | আল্লাহুম্মান্তাসসালাম – অমিঙ্কাস সালাম- তাবারাক্তা ইয়া জালজালালী ওয়াল ইকরাম। | ১ বার |
০৩ | «لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ» | লাইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা-শারিকালাহু, লাহুল মুল্কু অলাহুল হামদু য়ুহয়ি অয়ুমিতু অহুয়ালাকুল্লি সাইয়িন কদির। | ১০ বার |
০৪ | اَللّهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَبْعَثُ عِبَادَكَ | আল্লাহুম্মা কিনি আজাবাকা ইয়াউমা তাবআছু ইবাদাক। | ১
বার |
০৫ | ﺍﻟﻠَّﻬُﻢَّ ﺃَﻋِﻨِّﻲ ﻋَﻠَﻰ ﺫِﻛْﺮِﻙَ، ﻭَﺷُﻜْﺮِﻙَ، ﻭَﺣُﺴْﻦِ ﻋِﺒﺎﺩَﺗِﻚَ | আল্লাহুম্মা আয়িন্নি আলা জিকরিকা,অ শুকরিকা,অ হুসনি ইবাদিক। | ১
বার |
০৬ | سوره الاخلاص سوره الفلق سوره الناس | সূরা আল-ইখলাস, সূরা আল-ফালাক, সূরা আল-নাস। | ১
বার |
০৭ | سبحان الله(٣٣) الحمد لله(٣٣) الله اكبر(٣٤) | সুবহানাল্লাহ(৩৩) আলহামদুলিল্লাহ(৩৩) আল্লাহু আকবার(৩৪) | ১০০বার |
০৮ | ايه الكرسي | আয়াতুল কুরসি | ১ বার |
০৯ | لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِالله | লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ | ১ বার |
১০ | اَللّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الَجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ | আল্লাহুম্মা লা-মানিয়া লিমা আয়তাইতা অলা মুয়তিয়া লিমা মানায়তা অলা ইয়ানফায়ু যাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দি। | ১ বার |
১১ | لاَ إِلهَ إِلاَّ الله وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَ هُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ | লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহদাহু লা-শারিকালাহু লাহুল্মুল্কু অলাহুলহামদু অহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কদির। | ১ বার |
১২ | لآ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ، لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُوْنَ | লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অলা নায়বুদু ইল্লাল্লাহু লাহুন নিয়মাতা অলাহুল ফাদলু অলাহুছানায়ু, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিসিনা লাহুদ্দিনা অলাও কারহাল কাফিরুন। | ১ বার |
📌আরোও কিছু দোয়া (আমল)
আরবি | বাংলা উচ্চারণ | বার |
درود الشريف | দুরুদ শরীফ/ ফজর এবং মাগরিবের পর | ১০ বার |
سبحان الله وبحمده | সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি/ফজর এবং মাগরিবের পর | ১০০ বার |
➡️নামাজ পরবর্তী আমলের গুরুত্ব
নামাজের পরপরই ইবাদতের যে সময়টি থাকে, তা দোয়া কবুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। তাই নবীজি (সা.) ফরজ নামাজ শেষ করার পরে কখনোই হঠাৎ উঠে চলে যেতেন না। বরং কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল করতেন, যা তিনি সাহাবাদেরও করতে উৎসাহিত করতেন।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফরজ নামাজের পরবর্তী আমলগুলো আমাদের জন্য অসাধারণ দিকনির্দেশনা:
- এটি আমাদের মনকে পরিশুদ্ধ করে
- আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গভীর করে
- শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে
- দোয়ার সময় ও ফজিলত কাজে লাগানো হয়
➡️গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় বিষয়:
- আমলগুলো ফরজ মনে করা যাবে না, সুন্নাত বা মুস্তাহাব হিসেবে পালন করতে হবে।
- সবসময় অন্তর দিয়ে, একাগ্রভাবে আমল করতে হবে।
- সম্মিলিত দোয়া করা যায়, তবে নিয়মিত না করলে ভালো।
ফরজ নামাজের পর তাসবিহ সমূহ
ফরজ নামাজের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাসবিহ ও দোয়া রয়েছে যা পাঠ করা সুন্নত। সাধারণত, ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ, এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করা হয়। এছাড়াও, অন্যান্য তাসবিহ এবং দোয়াও পাঠ করা যেতে পারে।
ফরজ নামাজের পর যে তাসবিহ ও দোয়াগুলো সাধারণত পড়া হয়:
- ➡️সুবহানাল্লাহ (سُبْحَانَ اللهِ) – ৩৩ বার।
- ➡️আলহামদুলিল্লাহ (اَلْحَمْدُ للهِ) – ৩৩ বার।
- ➡️আল্লাহু আকবার (اللهُ اَكْبَرُ) – ৩৪ বার।
- ➡️ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন কাদির – ১ বার।
এছাড়াও, কিছু গুরুত্বপূর্ণ দোয়া ও জিকির রয়েছে যা নামাজের পর পাঠ করা হয়, যেমন-
- آية الكرسي (আয়াতুল কুরসি)
- সূরা ইখলাস, ফালাক্ব, নাস (প্রতিটি ৩ বার করে)
- দরুদ শরিফ (১০ বার)
এই আমলগুলো নিয়মিতভাবে করার চেষ্টা করা উচিত, যা আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভের একটি মাধ্যম।
নবী মুহাম্মদ ﷺ ফরজ নামাজের পর যে তাসবিহ বা যিকির করতেন এবং সাহাবায়ে কেরামদের উৎসাহিত করতেন, সেগুলো ইসলামী ইবাদতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফরজ নামাজের পর আল্লাহর প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ও গুণবাচক বাক্যসমূহ স্মরণ করার এই আমলকে তাসবিহ বলা হয়। এসব আমল কেবল মুখের যিকির নয়, বরং তা অন্তরের সংযোগের এক বিশেষ মাধ্যম।
➡️ফরজ নামাজের পর তাসবিহ: ইসলামে গুরুত্ব
নামাজের পরকার্যে তাসবিহ একটি মুস্তাহাব (পছন্দনীয়) এবং সুন্নাতে রাসুল (ﷺ) আমল। এটি এমন একটি সময়, যখন বান্দা সরাসরি আল্লাহর সাথে কথোপকথনে লিপ্ত থাকে। তাই আল্লাহর প্রশংসা ও স্মরণ এই সময়ে অধিক প্রভাবশালী হয়।
➡️কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো”
(সূরা বাকারা ২:১৫২)
➡️তাসবিহ ফাতিমা (তাসবিহাতুল নামাজ)
এই তাসবিহ সবচেয়ে প্রসিদ্ধ, এবং প্রতিটি ফরজ নামাজের পরে পড়া যায়:
✅ উচ্চারণ ও সংখ্যা:
- ৩৩ বার: سُبْحَانَ اللَّهِ (সুবহানাল্লাহ)
- অর্থ: আল্লাহ পবিত্র, তিনি সমস্ত ত্রুটিমুক্ত।
- ৩৩ বার: الْحَمْدُ لِلَّهِ (আলহামদুলিল্লাহ)
- অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
- ৩৪ বার: اللَّهُ أَكْبَرُ (আল্লাহু আকবার)
- অর্থ: আল্লাহ মহান।
📘 হাদিস:
“নবীজি (ﷺ) বললেন, ‘তোমরা কি তোমাদের উপকারে এমন একটি জিনিস দেখিয়ে দেবো, যা তোমরা করলে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন? প্রতিদিন রাতে ও প্রত্যেক নামাজের পর সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পড়ো।”— (সহিহ বুখারী: ৩৭০৫, সহিহ মুসলিম: ২৭২৭)
➡️অন্যান্য সংক্ষিপ্ত তাসবিহ
নামাজের পরে আরো কিছু তাসবিহ ও যিকির আছে, যেগুলো রাসূল (ﷺ) নিজে পড়তেন বা সাহাবাদের পাঠ করতে বলতেন:
- ✅ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ
- উচ্চারণ: সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি
- অর্থ: আমি আল্লাহকে তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্র ঘোষণা করছি।
📘 হাদিস:
“যে ব্যক্তি দিনে ১০০ বার এটি পড়বে, তার গুনাহগুলো মাফ হয়ে যাবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মতো হয়।” — (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম)
➡️সম্মিলিত দোয়ার আগে একক তাসবিহ
অনেক সময় মসজিদে নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত হয়। তার আগে সাহাবারা একা একা এসব তাসবিহ করতেন। অর্থাৎ, তাসবিহগুলো হলো ব্যক্তিগত ইবাদতের অংশ — যাকে সম্মিলিতভাবে পড়া বাধ্যতামূলক নয়।
➡️কেন তাসবিহ গুরুত্বপূর্ণ?
- নামাজের পর তাসবিহ মানে আল্লাহর প্রশংসা, যা শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্তি দেয়।
- এটি বান্দাকে বিনয়ী করে তোলে।
- আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ দৃঢ় হয়।
- আত্মশুদ্ধি ও পাপ মোচনের মাধ্যম।
ফরজ নামাজের পর যেসব তাসবিহ নবীজি (ﷺ) শিখিয়েছেন, সেগুলো শুধু জিহ্বার যিকির নয়, বরং আত্মার প্রশান্তি ও আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের এক মাধ্যম। এই তাসবিহগুলো নিয়মিত আমল করা একজন মুসলমানের ঈমানী জীবনের মেরুদণ্ড।
❝ তুমি তোমার রবের স্মরণ করো ফরজ নামাজের পরে — এটাই মু’মিনের পরিচয় ❞
— (সূরা ক্বাফ: ৪০)
ফরজ নামাজের পর আমল
ফরজ নামাজের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে যা নিয়মিতভাবে করা উচিত। এর মধ্যে আছে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার) পাঠ করা, ইস্তেগফার (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা) করা, দরুদ শরীফ পাঠ করা, আয়াতুল কুরসী তেলাওয়াত করা এবং দোয়া করা।
ফরজ নামাজের পর করণীয় কিছু আমল নিচে উল্লেখ করা হলো:
➡️তাসবিহ পাঠ: প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর ৩৩ বার “সুবহানাল্লাহ”, ৩৩ বার “আলহামদুলিল্লাহ”, এবং ৩৪ বার “আল্লাহু আকবার” পাঠ করা উচিত। এই তাসবিহগুলো মনোযোগ সহকারে ধীরে ধীরে পাঠ করা উত্তম।
➡️ইস্তেগফার: “আস্তাগফিরুল্লাহ” (أَسْتَغْفِرُ اللهَ) তিনবার অথবা আরো বেশি বার পাঠ করা উচিত। এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া হয়।
➡️দরুদ শরীফ: “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়ালা আলি মুহাম্মাদ” (اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ) পাঠ করা উত্তম। এটি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর দরুদ পাঠ করা, যা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
➡️আয়াতুল কুরসী: ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসী (সূরা আল-বাকারার ২৫৫ নং আয়াত) পাঠ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।
➡️দোয়া: ফরজ নামাজের পর নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, মুসলিম উম্মাহর জন্য এবং সকল মানুষের জন্য দোয়া করা উচিত।
➡️অন্যান্য আমল: ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর সূরা ইখলাস, ফালাক্ব, এবং নাস প্রত্যেকটি সূরা তিনবার করে পাঠ করা উচিত। এই আমলগুলো নিয়মিতভাবে করা উচিত, কেননা এগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম।
ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত
ফরজ নামাজের পর সম্মিলিত মোনাজাত (সবার একত্রে ইমামের নেতৃত্বে দোয়া করা) বিষয়ে ইসলামী শরিয়তে বিভিন্ন মাযহাব ও আলেমদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত রয়েছে। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো—
➡️সম্মিলিত মোনাজাত: কী?
ফরজ নামাজ শেষ করে ইমাম ও মুসল্লিরা একত্রে এক কণ্ঠে বা ইমামের কণ্ঠে আল্লাহর কাছে দোয়া করা এবং মুসল্লিরা ‘আমীন’ বলা— এটিই সম্মিলিত মোনাজাত।
➡️সম্মিলিত মোনাজাতের পক্ষে দলিল ও যুক্তি:
১. ইমামের দোয়ার পেছনে আমীন বলা
হাদিসে প্রমাণ আছে, রাসূল (সা.) মসজিদে সাহাবীদের সামনে দোয়া করতেন এবং সাহাবারা “আমীন” বলতেন। যদিও এটি ফরজ নামাজের পর সবসময় নিয়মিত হত কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
২. হানাফি মাযহাব ও উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপট
হানাফি মাযহাব মতে, ফরজ নামাজ শেষে সম্মিলিত মোনাজাত করা বৈধ ও মুস্তাহাব (উত্তম) — যদি নিয়মিত ফরজ মনে না করা হয়।
ইসলামিক স্কলাররা বলেন, এটি একটি উত্তম অভ্যাস, যাতে সাধারণ মানুষ দোয়া করা শিখে ও আল্লাহর স্মরণে থাকে।
৩. উমর (রা.) ও সাহাবীদের যুগে সম্মিলিত দোয়ার দৃষ্টান্ত
বিভিন্ন যুদ্ধ ও বিপদের সময় সাহাবারা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। যেমন: ইস্তিসকার নামাজে।
➡️সম্মিলিত মোনাজাতের বিপক্ষে মত:
১. নিয়মিতভাবে করা হলে ‘বিদআত’ হওয়ার আশঙ্কা
কেউ কেউ বলেন, রাসূল (সা.) ও সাহাবারা ফরজ নামাজ শেষে নিয়মিত সম্মিলিত মোনাজাত করতেন না। সুতরাং একে বাধ্যতামূলক বা নিয়মিত করে নিলে তা বিদআত (নতুন ইবাদত) হতে পারে।
২. ইবাদতের নিয়ম ও রূপ নির্দিষ্ট হওয়া উচিত
নামাজের পর ইচ্ছেমতো ইবাদত করা বৈধ, কিন্তু যদি কেউ মনে করে “এটিই একমাত্র সঠিক নিয়ম”, তাহলে সেটা ভুল ও বিদআত হয়ে যায়।
➡️ইসলামী ফিকহ কাউন্সিল ও বিশিষ্ট আলেমদের মতামত:
দারুল উলূম দেওবন্দ: সম্মিলিত দোয়া বৈধ, তবে বাধ্যতামূলক বা নিয়মিত ভাবা ঠিক নয়
ইবনে তাইমিয়া: দলবদ্ধভাবে দোয়া করা জায়েজ, তবে নিয়মিত না করা উত্তম
শায়খ বিন বায / শায়খ উসাইমিন: নিয়মিত সম্মিলিত দোয়া করাকে বিদআত মনে করেন
➡️আপনি কীভাবে পালন করবেন?
✅ যদি মসজিদে সবাই সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করে, আপনি অংশ নিতে পারেন — নিয়ত করুন, “এটা সুন্নাত নয়, বরং ইবাদতের একটি মাধ্যম”।
✅ নিজেও চাইলে একা বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, বেশি মনোযোগ ও খুশি নিয়ে।
ফরজ নামাজের পর জিকির সমূহ
ফরজ নামাজের পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিকির ও দোয়া রয়েছে যা নিয়মিত পাঠ করা সুন্নত। এর মধ্যে রয়েছে “সুবহানাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “আল্লাহু আকবার” ৩৩ বার করে পড়া, “আস্তাগফিরুল্লাহ” (আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা) ৩ বার পড়া, এবং দরূদ শরীফ পড়া।
এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিকির ও দোয়া উল্লেখ করা হলো:
➡️তাসবিহ: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার – প্রত্যেকটি ৩৩ বার করে।
➡️ইস্তিগফার: আস্তাগফিরুল্লাহ – ৩ বার।
➡️কালেমা: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির।
➡️দোয়া: আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম, ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাকতা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম।
➡️অন্যান্য:দরূদ শরীফ, সুরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস প্রত্যেকটি ৩ বার করে ফজর ও মাগরিবের পর পড়া। এছাড়া আয়াতুল কুরসি ও অন্যান্য দোয়াও পড়া যেতে পারে।
এই আমলগুলো নিয়মিত করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভ করা যায় এবং পাপ মোচন হয়।
ফরজ নামাজের পর মোনাজাত করা যাবে কি
হ্যাঁ, ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা জায়েজ আছে। তবে এটি নামাজের অংশ হিসেবে নয়, বরং নামাজের পর ব্যক্তিগত দোয়া হিসেবে ধরা হয়। ইসলামিক স্কলারদের মতে, ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা একটি বৈধ আমল। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) থেকেও বিভিন্ন স্থানে দোয়া করার প্রমাণ পাওয়া যায়, এবং ফরজ নামাজের পর দোয়া করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
কিছু ক্ষেত্রে, ফরজ নামাজের পর সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দোয়া করা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সম্মিলিতভাবে হাত তুলে দোয়া করার উদাহরণ স্থাপন করেননি, তাই এটি করা উচিত নয়। তবে, কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে দোয়া করেন, তবে তা জায়েজ আছে। সুতরাং, ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা যাবে, তবে তা নামাজের অংশ হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্য।
লেখকের শেষ মতামত
এই লেখার মাধ্যমে আমরা জেনেছি ফরজ নামাজের পর নবীজির আমলসমূহ। তবে শুধু জানা নয়, মানার মধ্যেই রয়েছে আসল সফলতা। চেষ্টা করব প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর তাসবীহ ও দোয়াগুলো পড়ার। প্রতি ওয়াক্তে না পারলেও অন্তত ফজর, মাগরিব বা ইশার পর সময় বের করে আমল আমল গুলো করার। আর সময় কম থাকলে ছোট ছোট তাসবীহগুলো অন্তত যেন আদায় হয়।