কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। গ্রীষ্মকালে এ ফলটি হয়ে থাকে। কাঁঠাল আঁশজাতীয় খাবার, এর মধ্যে প্রচুর পুষ্টি উপাদান রয়েছে। এটি খেলে আমাদের শরীরে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কাঁঠাল শুধু ফল হিসেবে খেলে উপকার পাওয়া যায় না। কাঁঠালের পাতাও আমাদের বিভিন্ন উপকারে আসে। এছারাও কাঁঠাল গাছের কাঠ, কাঁঠাল গাছের শিকড়, বাকল, কাঁঠালের বিচি এবং কাঁঠাল সবজি হিসাবেও খুবই উপকারি। কাঁঠাল গাছ নিয়ে কিছু তথ্য আজকের আর্টিকেলে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
কাঁঠাল গাছ কোন মাটিতে ভালো হয়, কাঁঠাল পাতার উপকারিত কি, কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট এবং কাঁঠাল পাতা আমরা কিভাবে ব্যবহার করবো এসব বিষয় নিয়ে আজকের আর্টিকেল। এসব বিষয় জানতে আজাকের আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়বেন। আশা করি কাঁঠাল সম্পর্কিত সকল তথ্য আজকের আর্টিকেলটি পড়লে জানতে পারবেন। চলুন তাহলে শুরু করি কাঁঠাল পাতার উপকারিতা এবং কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা।
কাঁঠাল গাছ কোন মাটিতে ভালো হয়
বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় কাঁঠালের গাছ রয়েছে। কাঁঠাল পাকা এবং সবজি দুইভাবেই খাওয়া হয়। কাঁঠালের মধ্যে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্কসহ এর মধ্যে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন এ’ সি’ এবং ভিটামিন বি সহ আরও বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের সুস্বাস্থের জন্য প্রয়োজন। তাই প্রত্যেক বাড়িতে একটি কাঁঠাল গাছ থাকলে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটবে। এছারাও কাঁঠালের চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে। কাঁঠালের চাষ সঠিক ভাবে করলে এর ফলন অধিক পরিমাণে হয়ে থাকে। তাই যারা কাঁঠাল চাষ করতে চান তারা সঠিক মাটি নির্বাচন করে, সঠিক পদ্ধতিতে কাঁঠালের চাষ করবেন। জেনে নিন কাঁঠাল গাছ কোন মাটিতে ভালো হয়-
মাটি নির্বাচন: উঁচু ও মাঝারি উঁচু সুনিষ্কাশিত উর্বর জমি, যেখানে পানি দাঁড়ায় না এমন ধরনের মাটি কাঁঠার চাষের জন্য উপযোগি। এ ধরনের মাটিতে কাঁঠালের চাষ করা হলে ফলন বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে। কাঁঠালের বীজ বপন করে চারা তৈরি করা হয়। কাঁঠালের ফলন ভালো পেতে হলে পুষ্ট বড় বীজ দেখে, বীজ বপন করে , বপনের ২ মাস পরে চারা বীজতলা থেকে তুলে মূল জমিতে রোপন করতে হবে।
চারা রোপন: চারা রোপনের সঠিক সময় হলো জুন থেকে আগষ্ট মাসে। গাছ ও লাইনের দূরত্ব থাকতে হবে ১২ মিটার করে।
পরিচর্যা: কাঁঠাল গাছ রোপন করার পর এর সঠিক যত্ন নিতে হবে। চারা রোপনের পর সময়মতো সঠিক সময়ে সেচ প্রদান এবং আগাছা দমন করতে হবে। তাহলে গাছের বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হবে। কাঁঠাল গাছের বিভিন্ন রোগবালাই ও পোঁকামাকড়ের জ¤œ নেই, সেগুলোর আক্রমন থেকে গাছকে রক্ষা করতে হবে। কাঁঠাল গাছে উঁইপোকা, স্কেল পোকা, ফল ছিদ্রকারি পোকা, জাব পোকা এবং ছাতরা পোকাসহ বিভিন্ন পোকামাকড় কাঁঠাল গাছে আক্রমন করে। এসব পোকা মাকড়েরর হাত থেকে গাছকে রক্ষা করতে সময়মতো কীটনাশক গাছে স্প্রে করতে হবে। এছারাও কাঁঠাল গাছের ছত্রাকের আক্রমনে কাঁঠাল পঁচা রোগ এবং মুচিঝরা রোগ হয়ে থাকে। এসব রোগ থেকে কাঁঠাল গাছকে রক্ষা করতে ছত্রাকনাশক গাছে প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে সঠিক পরিচর্যা একং সঠিক যত্ন নিলে গাছ সুস্থ ও সবল থাকবে এবং ফলের ফলন বেশি হবে। এরপর ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে ফল পাকতে শুরু করে, সাধারনত জৈষ্ঠ ও আষাড় মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়।
কাঁঠাল পাতার উপকারিতা
কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল, এই ফলের রয়েছে বিভিন্ন উপকার। শরীরের মাংসপেশী গঠন, হজম শক্তি বৃদ্ধি, ওজন কমাতে, টেনশন কমাতে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, হাঁপানি প্রতিরোধে, এজমা প্রতিরোধে, ক্যান্সার প্রতিরোধে, চুল, চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ ভালো রাখা ছাড়াও শরীরে বিভিন্ন উপকার মেলে কাঁঠাল খেলে। কাঁঠাল ফল আমাদের স্বাস্থের জন্য যেমন উপকারি তেমনি কাঁঠালের পাতার রয়েছে বিভিন্ন উপকারি গুন। এছারাও কাঁঠাল গাছের পাতা দিয়ে বাড়তি আয় করা সম্ভব হচ্ছে। কাঁঠাল সাধারনত বছরে একবার ফলন হয়। কিন্তু কাঁঠালের পাতা সারাবছর বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করছে কৃষকরা।
ছাগলের খাবারের বেশ উপযোগি একটি উপাদান হলো কাঁঠাল গাছের পাতা। ছাগলের খুবই পচ্ছন্দের একটি খাবার হলো কাঁঠাল পাতা, এতই পচ্ছন্দ যে কাঁঠাল পাতার সাথে লেগে থাকা ডগাও পর্যন্ত খেয়ে ফেলে ছাগলেরা। কাঁঠাল পাতার মধ্যে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি’ এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্সসহ থায়ামিন, ইথানল, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফাইবার, জিঙ্ক ইত্যাদি উপাদান রয়েছে। এছারাও কাঁঠাল পাতার মধ্যে কার্বহাইড্রেটের মাত্রা বিদ্যমান থাকে। এসব পুষ্টি উপাদান কাঁঠাল পাতা খাওয়ার ফলে ছাগলেরা পেয়ে থাকে। কাঁঠাল পাতা ছাগলেরা খেলে, ছাগলের পাচনক্রিয়া শক্তিশালী হয়, হজমে ভালো কাজ করে এবং মাংসপেশী মজবুত হয়। পাতা খেলে ছাগলের মুখে রুচি হয় ফলে অনান্য খাবারের প্রতি চাহিদা বাড়ে। কাঁঠাল পাতা খাওয়ার ফলে ছাগলের মাংস ও দুধ বৃদ্ধি পায়। এ খাবার ছাগল অধিক মাত্রায় খেয়ে ফেললেও ছাগলের কোনো পার্শপ্রতিক্রিয়া দেখা দিবে না।
কাঁঠাল পাতা ডায়াবেটিকস রোগিদের জন্য একটি ঔষুধি পাতা। যারা ডায়াবেটিকস রোগে আক্রান্ত তারা কাঁঠালের পাতার রস বের করে খেতে পারেন। এ পাতার রস খেলে ডায়াবেটিকস নিয়ন্ত্রনে থাকে। এছারাও এ পাতার রস খেলে চোখের স্বাস্থ ভালো থাকে।
ব্যাথা নিরাময়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে কাঁঠাল গাছের পাতা। যেকোনো ধরনের ব্যাথা আপনার শরীরে দেখা দিলে কিংবা কোনো জায়গা ক্ষত হলে, সেসব স্থানে কাঁঠাল গাছের পাতা ব্লেন্ড করে লাগালে আরাম পাওয়া যায়। এছারাও চর্মরোগ নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে কাঁঠাল পাতার রস।
কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট
বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে কাঁঠালের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। কাঁঠাল গাছের ফল এক প্রকার হলদে রঙের, মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে। গ্রাম্য ভাষায় অনেকেই এ ফলকে এঁচোড় নামে চিনে। কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট হলো, এ গাছের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ, উপবৃত্তাকার ও সরল হয়ে থাকে। এ গাছের পাতাগুলো গাছের সাথে একান্তভাবে সাজানো থাকে। এ গাছের পাতার বোঁটাসহ সমগ্র শরীরে গাঢ় শে^তকোষ বিদ্যমান থাকে। এর পত্রমূকুল দুটি খড় সাদা, স্বল্পায়ু প্রায় নৌকাকৃতি উপবৃতে আবৃত থাকে। এ পাতাগুলোর রঙ গাঢ় কমলা রঙের হলে, পাতা গুলো নিজ থেকেই ঝড়ে পড়ে যায়।
কাঁঠাল গাছ আকারে মাঝারি হয়ে থাকে এবং এ গাছ প্রায় ৮ মিটার মতো লম্বা হয়ে থাকে। এ গাছ রোপন করার সাত বছরের মধ্যেই ফল ধরা শুরু করে। এ গাছ সহবাসী উদ্ভিদ বলে বিবেচিত, তাই একই গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথকভাবে ধরে। কান্ডের গোড়ায় স্ত্রী ফুল এবং গোড়া ও শীর্ষে পুরুষ ফুল ধরে। ফুলের মঞ্জুরীর উপরিভাগ নরম ও মসৃন প্রকৃতির হয়ে থাকে। স্ত্রী মঞ্জরীদন্ডগুলো আকারের মোটা এবং খাটো হয়। এ গাছের ফল ডালের গা বেয়ে ধরে এবং এ ফল মে থেকে আগস্ট মাসে পাকতে শুরু করে। কাঁঠালের বেশ কয়েকটি জাত রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-গালা, খাজা রসখাজা, সিঙ্গাপুর, রুদ্রাক্ষি, সিলোন, বারোমাসি, গোলাপগন্ধা, চম্পাগন্ধা প্রভৃতি। তবে এসবগুলোই বাংলাদেশে উৎপন্ন হয় না। উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২, বারি কাঁঠাল-৩, বারি কাঁঠাল-৪, বারি কাঁঠাল-৫। এসবগুলোই বাংলাদেশে উৎপাদন করা হয়। এছারাও কাঁঠালের নতুন একটি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে যার নাম বারি কাঁঠাল-৬। এ জাতের কাঁঠাল গাছটি রোপনের দেড় বছরেই ফল দেখা দিবে, এটি বারোমাসই পাওয়া যাবে এবং এ জাতের কাঁঠালের থাকবে না কোনো প্রকার আঠা।
কাঁঠাল পাতার ব্যবহার
কাঁঠাল গাছের সবকিছুই উপকারি, কাঁঠাল গাছের ফল, ডালপালা, কান্ড, শিকড়, বাকল, বীজসহ এর পাতাও বেশ উপকারি। কাঁঠাল গাছের পাতার মধ্যে বিভিন্ন গুনাগুন রয়েছে এবং এ পাতা বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জেনে নিন কি কাজে কাঁঠাল গাছের পাতা ব্যবহার করা হয়-
- কাঁঠাল গাছের পাতা জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা হয়। এ গাছের পাতা শুকিয়ে গেলে নিজ থেকেই ঝড়ে পড়ে যায়, সেই শুকনো পাতাগুলো না ফেলে জ¦ালানির কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
- কাঁঠাল পাতার মধ্যে বিভিন্ন ভেষজ গুন রয়েছে। একজিমা, চুলকানি রোগিদের এ গাছের কচি পাতা সিদ্ধ করে খাওয়ানো হয়। এছারাও এ পাতা দাদ স্থানেও লাগালে দাদ থেকে উপশম পাওয়া যায়।
- এ গাছের পাতা গৃহপালিত প্রানীর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এ পাতার মধ্যে বিভিন্ন পুষ্টিগুন রয়েছে, যা খাওয়ার ফলে প্রানীর মাংস ও দুধ বৃদ্ধি পায়।
- ক্ষত বা ব্যথাযুক্ত স্থানে এ পাতার রস ব্যবহার করা হয়।
- রক্তে শর্করার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনে কাঁঠালের পাতা এবং শিকড় ব্যবহার হয়ে থাকে। এ পাতায় এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে যা খাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার বৃদ্ধি ঘটে।
- কাঁঠাল পাতার রস কোষ্টকাঠিন্য, ডায়াবেটিকস এবং চোখের স্বাস্থ ভালো রাখতে ব্যবহার করা হয়।
- ত্বকের স্বাস্থ ভালো রাখতে কাঁঠাল গাছের কচি পাতা ব্লেন্ড করে ব্যবহার করা হয়।
- কাঁঠাল পাতা বড়া অথবা পাকোড়া বানাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কাঁঠালের কয়েকটি কচি পাতা পরিষ্কার করে ধুয়ে কুচি কুচি করে কেটে, তার সাথে কাঁচা মরিচ কুচি, লবন, হলুদের গুড়া এবং পরিমাণ মতো চালের গুড়া একসাথে সবগুলো উপকরন ভালো করে মিশিয়ে, সেই মিশ্রনটি তেলে ভেজে নিলে হয়ে যাবে কাঁঠাল পাতার বড়া।
- কাঁঠাল পাতার বড়া ছাড়াও এ পাতা পিঠা বানানোর কাজেও ব্যবহার করা হয়। এ পিঠা বানাতে, কাঁঠাল পাতা, তালের রস, চালের গুড়া, চিনি, নারকেল, দুধ, বেকিং পাউডার এবং শলার কাঠি বা টুথপিক এসব উপকরন লাগে। এ পিঠা- তালের রস এবং চালের গুড়া একসাথে মিশিয়ে কয়েকঘন্টা ঢেকে রাখার পর তার সাথে সবগুলো উপকরণ একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। এরপর কাঁঠাল পাতা পরিষ্কার করে নিয়ে সে পাতার কোণ বানিয়ে টুথপিক দিয়ে আটকিয়ে তার ভিতরে মিশ্রনটি দিয়ে ওপরে নারিকেল ছড়িয়ে ভাপের পাত্রে কিছুক্ষন ঢেকে রাখবেন, হয়ে যাবে কাঁঠাল পাতা দিয়ে পিঠা।
কাঁঠাল পাতার মধ্যে বিভিন্ন উপকারি গুন রয়েছে, তাই আমরা এসব গুন পেতে কাঁঠাল পাতা ব্যবহার করবো। কাঁঠাল গাছের কচি পাতা গাছ থেকে সংগ্রহ করে ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়ে চিবিয়ে খাবেন, তাহলে বিভিন্ন স্বাস্থ উপকারিতা আপনি পাবেন।
লেখকের শেষ বক্তব্য
কাঁঠাল পাতার উপকারিতা – কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আজকের এই ব্লগে সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি কাঁঠাল পাতার উপকারিতা – কাঁঠাল পাতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি আপনি এই ধরনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ব্লগ পোস্ট নিয়মিত পড়তে চান তাহলে আপনাকে প্রতিনিয়ত আমাদের এই ওয়েবসাইট ফলো করতে হবে।