কুরবানি করা কী? কুরবানির সুন্নত সমূহ কী ইসলামে কুরবানির গুরত্ব কতটুকু তা আমাদের অনেকের জানা নেই। মুসলিম হিসেবে অবশ্যই এ বিষয়গুলো আমাদের জানতে হবে। কুরবানি হচ্ছে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্দিষ্ট কোনো পশু জবেহ করা। ইসলামে কুরবানির গুরত্ব অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য বান্দা এটি করে থাকে। আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার একটি মাধ্যম হলো কুরবানি।
কতটাকা থাকলে কুরবানি ওয়াজিব হয়? কুরবানির সুন্নত সমূহ গুলো কী? আজকের আর্টিকেলে আপনাদের বিষয়গুলো জানাব। কুরবানি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ন পড়বেন।
কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত
কুরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমরা করে থাকি। মহান আল্লাহ তায়ালা কুরবানি দাতাকে অনেক পছন্দ করেন। কাদের জন্যে কুরবানি ওয়াজিব, কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত আপনাদের সামনে তুলে ধরব- যে ব্যক্তির কাছে আরবি জিলহজ্জ মাসের সূর্য উদয় হওয়ার পর ১০, ১১ এবং ১২ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বাহান্ন তোলা রূপা বা এর সমতুল্য সম্পদ কিংবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ন বা এর সমতুল্য পরিমাণ সম্পদ থাকে তাহলে সে ব্যক্তির ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরবানি গরু, মহিষ, ছাগল, উট, দুম্বা কিংবা ভেড়া যেকোনো একটি হতে পারে। সেটা আপনার পছন্দমতো। মহানবী হযরত মুুহাম্মদ (স.) জবেহ করার সময় যখন পশু শোয়াতেন তখন বলতেন- ইন্নি ওয়াজ জাহতু ওয়াজ হিয়া লিল্লাজি ফাতারস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাও ওয়ামা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সলাতি ওয়া নুসুকি ওয়া-মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রব্বিল আলামিন। লা শারিকালাহু ওয়াবি- জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাক। তারপর বিসমিল্লাহ আল্লহু আকবার বলে জবাই করতেন।
কুরবানির ওয়াজিব হওয়ার শর্ত-
১. মুসলমান হওয়া। অমুসলিমের জন্যে কুরবানি ওয়াজিব হবেনা। কাফের, মুশরিকের জন্য কুরবানি করার বিধান নেয়।
২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া- নাবালকের জন্য কুরবানি আবশ্যক নয়।
৩. সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারি হওয়া। কোনো পাগলের ওপর কুরবানি ওয়াজিব হয়না।
৪. স্বাধীন ব্যক্তি হতে হবে। পরাধীন ব্যক্তির জন্য কুরবানি নয়।
৫. মুকিম হওয়া। কোনো মুসাফির ব্যক্তির ওপর কুরবানি ওয়াজিব হয়না।
৬. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হবে। নিসাবটি হলো, ১০ জিলহজ্জ সূর্য উদয়ের পর থেকে, ১১ এবং ১২ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময়ে তাকে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ন বা সাড়ে বাহান্ন তোলা রূপা কিংবা এগুলোর সম পরিমাণ অর্থের মালিক হতে হবে।
কুরবানির সূন্নত সমূহ
আল্লাহর নিকট বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে গুরত্বপূর্ণ একটি দিন হলো কুরবানির দিন। সামর্থ অনুযায়ী প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানি করা ওয়াজিব। কুরবানি ইসলামের একটি অন্যতম ইবাদত। এই ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করা যায়। কুরবানি করার পাশাপাশি ঈদুল আযহার দিন কিছু সুন্নাত আছে যা আমাদের পালন করতে হবে। আল্লাহ রাসূল এই সুন্নাহ গুলোকে পালন করতেন। সুন্নাহ গুলো হলো –
১. ফজরে উঠে ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে আদায় করতে হবে।
২. মিশওয়াক বা ব্রাশ করা।
৩. গোসল করা।
৪. স্বাধ্যমতো নতুন পোশাক পড়া।
৫. কুরবানির দিন কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া।
৬. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া।
৭. ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে গিয়ে, অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা।
৮. তাকবীর পড়া। তাকবীরটি হলো- আল্লহু আকবার, আল্লহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লহু ওয়াল্লহু আকবার । আল্লহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ্।
৯. সকাল সকাল ঈদুল আযহার নামাজ পড়া।
১০. ঈদুল আযহার নামাজের পর পশু কুরবানি করা , নামাজের আগে না করা।
১১. ভায়ে ভায়ে বা প্রতিবেশির সাথে কোলাকুলি করা।
১২. কুরবানির গোশত গরীব দুঃখিদের দিয়ে খাওয়া।
এসব সুন্নত গুলোর মধ্য দিয়ে কুরবানির দিন অতিবাহিত করুন।
কুরবানি ফরজ কত বছর বয়সে
একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর বা নারী যাদের কাছে, ১০ জিলহজ্জ সূর্য উদয়ের পর থেকে ১১ এবং ১২ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সময় তাদের কাছে যদি নিসাব পরিমাণ স্বর্ন বা রূপা থাকে তাহলে তাদের উপর কুরবানি করা আবশ্যক। অপ্রাপ্ত বয়স্কোদের জন্য এ বিধান জরুরি নয় । অর্থাৎ সাবালকদের জন্য কুরবানি করা উত্তম। নাবালকদের জন্য নয়। সঠিক উপায়ে কুরবানি করতে হবে। কুরবানির পশুগুলোর মধ্যে তোমরা উট, ছাগল, দুম্বা, গরু কিংবা ভেড়া হতে পারে। উটের বয়স অন্তত পাঁচ বছর, আর গরু ও মহিষের হতে হবে দুই বছর, ছাগল ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে এক বছর হতে হবে। কুরবানির গোশত সঠিক ভাবে বন্টন করবেন। আল্লাহ রসূল বলেছেন, কুরবানির গোশত তোমরা নিজেরা খাও, আত্বীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশিদের খাওয়াও এবং যারা অশহায় গরিব তাদের জন্যে দান কর। এ আয়াত থেকে তিনটি ভাগ করার নির্দেশ পাওয়া যায়। তাই ওলামায়ে একরামের মতে তিনটি ভাগ করা উত্তম। তবে তিনভাগের ভাগ সমান না হলে এতে কোনো সমস্যা নেই।
স্বামী-স্ত্রী একসাথে কুরবানি করতে পারবে কী
এর উত্তর হলো হ্যাঁ অবশ্যই পারবেন। চলুন বিস্তারিত জানি- কুরবানি হলো আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের একটি মাধ্যম। আর্থিক ভাবে সাবলম্বি যারা তাদের জন্য কুরবানি করা জরুরি। স্বামী-স্ত্রী একসাথে কুরবানি করার ব্যপারে ওলামায়ে একরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন একটি পরিবারে যদি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ই চাকরি করেন এবং জিলহজ্জ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখ পর্যন্ত উভয়ের কাছে সাড়ে বাহান্ন তোলা রুপা অথবা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা এর সমপরিমান সম্পদ তাদের কাছে থাকে তাহলে উভয়য়ের পক্ষ থেকে কুরবানি করা উত্তম। আর পরিবারের অনেক সদস্য থাকলে যদি উপার্জনের মাধ্যক একজন থাকে তাহলে একজন কুরবানি করবেন। তবে তিনি চাইলে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা করে কুরবানি দিতে পারবেন। এটা জায়েজ তবে জরুরি নই। আবার অনেক ওলামায়ে একরাম বলেন-এক পরিবারের মধ্যে যদি উপার্জনের মাধ্যম অনেকেই থাকে , কিন্তু একজনের পক্ষ থেকেই কুরবানি দিতে চাই তাহলে সেটাও জায়েজ আছে। হাদিসে এসেছে, পরিবারের পক্ষ থেকে একজন দিলেও কুরবানি হয়ে যাবে। এখানে দুই পক্ষের দলিল শক্তিশালি এই দলিল নিয়ে বিরোধ করা যাবেনা। দুটির মধ্যে যেকোনো একটি করলেই কুরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে প্রত্যেক সামার্থবানদের পক্ষ থেকে কুরবানি করাটা নিরাপদ। এর থেকে যিনি কুরবানি দিবে তিনিও উপকৃত হবে এবং গরিব দুঃখীরাও গোশত পেয়ে উপকৃত হবে।
ইসলামে কুরবানির গুরত্ব কেন
আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যে আমরা কুরবানি করে থাকি। আমাদের রাসূল স. কোনো বছর কুরবানি করা বাদ দেননি। এটি হলো মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম নবীর একটি সুন্নাহ। সামর্থবান প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামিন কুরবানি করার হুকুম দিয়েছেন। আল্লাহ রাসূল স. বলেছেন- যার সামার্থ আছে অথচ সামার্থ থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করেনা সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে। তিনি এ কথা হুশিয়ার করে বলেছে। তার এ কথার মধ্য দিয়ে বুঝতে পারি কুরবানির গুরত্ব ঠিক কতটা। কুরবানি করা প্রত্যেক সামার্থ্যবান মুমিনদের জন্য অত্যবশক। কুরবানি হলো আত্মত্যাগ। এর মাধ্যমে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। কুরবানি করলে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন। কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে গড়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা কুরবানি কবুল করেন। কুরবানিকারী কিয়ামতের দিন জবাহ করা পশুর লোম, শিং, খুর, ইত্যাদি নিয়ে আল্লাহর কাছে হাজির হবেন। কুরবানির মাধ্যমে আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়, হিংসা বিদ্বেশ, লোভ-লালসা দূর হয়।
ঈদুল আযহার আগে চুল কাটা কী হারাম
জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ টি দিন খুবই গুরত্বপূর্ন। আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। হাদিসে এসেছে জিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের আমল, জিহাদের থেকেও বেশি। কারন যতগুলো মৌলিক ইবাদত আছে- সালাত, নফল সিয়াম, সাদকাহ, কুরবানি, হজ্জ এই সবগুলোর সমন্বয় করা হয়েছে যিলহজ্জ মাসে। জিলহজ্জ মাসের আমলগুলোর মধ্যে গুরত্বপূর্ন একটি আমল হলো ঈদুল আযহার আগে চুল না কাটা। রাসূল স. বলেছেন তোমাদের মধ্যে যারা, কুরবানি করার ইচ্ছা পোষণ করে তারা যেন জিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে কুরবানি সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত চুল ও নক না কাটে। অর্থাৎ যিনি কুরবানি করার ইচ্ছা পোষন করবেন শুধু তিনি এ কাজগুলো করবেন। পরিবারের অন্যরা এগুলো কাটতে পারেন সমস্যা নেই তবে না কাটলে সওয়াব আছে। নবী করীম স. কুরবানির ফযীলতে গরীবদের একটি আমল শিখিয়েছিলেন। তা হলো- জিলহজ্জ মাসের চাঁদ ওঠার আগেই তোমরা তোমাদের চুল ও নক কেটে ফেল চাঁদ উঠার পর আর কাটবেনা, একেবারে কুরবানি করার পর কেটো তাহলে তোমরা কুরবানির সওয়াব পাবে। এ থেকে বলা যায়, যারা কুরবানি করবে তাদের জন্য কুরবানির আগ পর্যন্ত চুল ও নক কাটা যাবেনা। পরিবারের অন্য সদস্যরা চাইলে কাটতে পারে। তবে সওয়াবের কাজ হবে এসব না কাটা।
লেখকের শেষ বক্তব্য
কত টাকা থাকলে কুরবানি ওয়াজিব – কুরবানির সুন্নত সমূহ সম্পর্কে আজকের এই ব্লগে সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি কত টাকা থাকলে কুরবানি ওয়াজিব – কুরবানির সুন্নত সমূহ সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি আপনি এই ধরনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ব্লগ পোস্ট নিয়মিত পড়তে চান তাহলে আপনাকে প্রতিনিয়ত আমাদের এই ওয়েবসাইট ফলো করতে হবে।