বাংলাদেশে অনেক এনজিও সংস্থা রয়েছে যেখানে কম সুদে লোন প্রদান করে থাকে, বিশেষ করে যারা অতি দরিদ্র এবং স্বল্প আয়ের মানুষ কিংবা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের আর্থিক সহায়তার জন্য। তো আপনি কি কম সুদে এনজিও লোন এর কথা ভাবছেন?
“কম সুদে এনজিও লোন” একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে যারা প্রচলিত ব্যাংক ঋণ পেতে সমস্যার সম্মুখীন হন কিংবা কম সুদে এনজিও লোন নিতে চান তাদের জন্য এই পোষ্টে আমরা কম সুদে এনজিও লোন সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
এনজিও লোন কত প্রকার
এনজিওগুলো বিভিন্ন ধরনের লোন প্রদান করে থাকে, যা মূলত সুবিধা বঞ্চিত ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে। এনজিও লোনের কিছু সাধারণ প্রকার নিচে দেওয়া হলো:
- ক্ষুদ্রঋণ: এটি সবচেয়ে প্রচলিত এনজিও লোন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কৃষক, বা ছোটখাটো ব্যবসা পরিচালনার জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়। সাধারণত, স্বল্প মেয়াদের জন্য অল্প পরিমাণের ঋণ দেওয়া হয়।
- অতিদরিদ্র ক্ষুদ্রঋণ: দারিদ্র্য সীমার সর্বনিম্ন স্তরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণে সুদের হার কম বা অনেক ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ কম থাকে এবং সহজ শর্তে দেওয়া হয়।
- ক্ষুদ্র উদ্যোগ ঋণ: অপেক্ষাকৃত বড় আকারের ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়, যেখানে ঋণের পরিমাণ ক্ষুদ্রঋণের চেয়ে বেশি হয়।
- কৃষি ঋণ: কৃষি কাজ, পশুপালন, মৎস্য চাষ ইত্যাদির জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়।
- শিক্ষা ঋণ: শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা বা পেশাগত প্রশিক্ষণের জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়।
- স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য ঋণ: স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ বা অন্যান্য স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রয়োজনে এই ঋণ দেওয়া হয়।
- গৃহ নির্মাণ/মেরামত ঋণ: ঘর নির্মাণ বা মেরামতের জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়।
কম সুদে এনজিও লোন কারা দেয়?
বাংলাদেশে অনেক এনজিও এবং ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (MFI) কম সুদে লোন প্রদান করে থাকে। এদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো:
- আশা (ASA): এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং স্বনির্ভর ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান।
- ব্র্যাক (BRAC): ব্র্যাকও দেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও, যা মাইক্রোফাইন্যান্স সেক্টরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ব্র্যাক বিভিন্ন ধরনের ঋণ সুবিধা দেয়।
- প্রশিকা (Proshika): এটিও একটি পরিচিত এনজিও যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
- উদ্দীপন (Uddipan): এটিও ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী একটি স্বনামধন্য এনজিও।
উল্লেখ্য, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (MRA) কর্তৃক নিবন্ধিত এনজিওগুলোই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।
কম সুদে এনজিও লোনের সুদের হার
সাধারণত, বাংলাদেশে এনজিও লোনের সুদের হার প্রচলিত ব্যাংক লোনের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও, কম সুদে বলতে সরকারি প্রণোদনার আওতায় বা নির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের আওতায় প্রদত্ত ঋণকে বোঝানো হতে পারে।
- আশা (ASA): প্রাথমিক ও বিশেষ লোনের ক্ষেত্রে ২৪% সুদের হার নেয় এবং MSME লোনের ক্ষেত্রে ২২% সুদের হার নেয়। তবে, সুদের হার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কম হতে পারে।
- ব্র্যাক: প্রাইমারি লোনের জন্য সুদের হার মূলত ১৫% থেকে ২০% এর মধ্যে হয়ে থাকে, তবে কিছু বিশেষ আরও কম হতে পারে।
- উদ্দীপন: প্রাইমারি লোনের জন্য সুদের হার মূলত ১১% থেকে ১৯% এর মধ্যে থাকে, তবে সেটা অবশ্য লোনের ধরন ও পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
- প্রশিকা: এখানে লোনের হার ২৪% প্রতি ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার ক্ষেত্রে, আর আপনি যদি ৫ লক্ষ টাকার উপরে লোন নেন তাহলে ২৪% সুদের হার দিতে হবে এবং ১০ লাখ বা তার বেশি টাকার জন্য ২২% সুদ প্রদান করতে হবে।
- পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (PKSF): পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে ঋণ নিলে সুদের হার সাধারণত ২৪% পর্যন্ত হতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ১৮% বা তার কমও হতে পারে। সুদের হার ঋণের প্রকার এবং প্রকল্পের উপর নির্ভর করে।
তবে উল্লিখিত তথ্য দ্রত সময়ে পরিবর্তনশীল, সেহেতু এনজিও এর ওয়েবসাইট বা শাখায় গিয়ে যোগাযোগ করা অতি উত্তম। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু এনজিও প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১৪% বা তার কম সুদে ঋণ প্রদান করে।
কম সুদে এনজিও লোনের যোগ্যতা
এনজিও লোনের যোগ্যতা সাধারণত ব্যাংক ঋণের চেয়ে কম কঠিন হয়। তবে কিছু সাধারণ যোগ্যতা পূরণ করতে হয়:
- নাগরিকত্ব: বাংলাদেশের স্থায়ী নাগরিক হতে হবে।
- দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষ: বেশিরভাগ এনজিও লোন দরিদ্র বা নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তৈরি করা হয়, যারা প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
- ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা/কৃষক/ছোট ব্যবসায়ী: সাধারণত আয়বর্ধক কার্যক্রমের জন্য এই ঋণ দেওয়া হয়, তাই আবেদনকারীকে কোনো ক্ষুদ্র উদ্যোগ, কৃষি কাজ বা ছোট ব্যবসার সাথে জড়িত থাকতে হবে।
- বয়স: সাধারণত ১৮ থেকে ৬০/৬৫ বছরের মধ্যে হতে হয়।
- সঞ্চয় হিসাব: বেশিরভাগ এনজিওর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে একটি সঞ্চয় হিসাব থাকতে হবে।
- সদস্যপদ: অনেক এনজিওতে ঋণ নেওয়ার আগে তাদের কোনো সমিতি বা দলের সদস্য হতে হয় এবং নিয়মিত সঞ্চয় জমা দিতে হয়।
- পরিবারের মাসিক আয় ও জমির পরিমাণ: অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের মাসিক আয় এবং মালিকানাধীন জমির পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার নিচে হতে হয়।
কম সুদে এনজিও লোনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
এনজিও লোনের জন্য সাধারণত খুব বেশি কাগজপত্র লাগে না, যা এর একটি বড় সুবিধা। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো নিম্নরূপ হতে পারে:
- জাতীয় পরিচয়পত্র: আবেদনকারী এবং গ্যারান্টার/স্বামীর জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদের ফটোকপি।
- পাসপোর্ট সাইজ ছবি: আবেদনকারী এবং গ্যারান্টার/স্বামীর সাম্প্রতিক পাসপোর্ট আকারের ছবি।
- আবেদনপত্র: এনজিও কর্তৃক প্রদত্ত নির্ধারিত আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে।
- ট্রেড লাইসেন্স (যদি থাকে): ক্ষুদ্র ব্যবসা বা উদ্যোগের জন্য প্রযোজ্য।
- ব্যাংক স্টেটমেন্ট: বড় অঙ্কের লোনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে।
- জমির কাগজপত্র (যদি থাকে): কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে বা বড় লোনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হতে পারে, যদিও বেশিরভাগ ক্ষুদ্রঋণ জামানতবিহীন হয়।
- সদস্য পাসের কপি: যদি কোনো সমিতির সদস্য হয়ে থাকেন।
কম সুদে এনজিও লোনের পদ্ধতি
এনজিও লোনের আবেদন প্রক্রিয়া সাধারণত সহজ এবং দ্রুত হয়:
- প্রথমে আপনি যে এনজিও থেকে লোন নিতে ইচ্ছুক, তাদের স্থানীয় শাখায় যোগাযোগ করতে হবে।
- অনেক এনজিওতে ঋণ পেতে হলে তাদের কোনো সমিতি বা দলের সদস্য হতে হয়। সদস্য হওয়ার পর নিয়মিত সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে সঞ্চয় জমা দিতে হয়।
- নির্দিষ্ট আবেদনপত্র সংগ্রহ করে পূরণ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
- এনজিও কর্মীরা আপনার দেওয়া তথ্য এবং ব্যবসার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য সরেজমিনে পরিদর্শন করতে পারেন।
- আবেদন এবং যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সফল হলে ঋণ অনুমোদন করা হবে।
- অনুমোদনের পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে (অনেক ক্ষেত্রে ১-২ দিনের মধ্যে) ঋণ বিতরণ করা হয়।
- সাধারণত সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এনজিও কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বা নির্ধারিত কেন্দ্রে কিস্তি সংগ্রহ করেন।
কম সুদে এনজিও লোনের সুবিধা
কম সুদে এনজিও লোনের অনেক সুবিধা রয়েছে, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য:
ব্যাংক ঋণের তুলনায় এনজিও লোন পাওয়া অনেক সহজ, কারণ জামানত বা জটিল কাগজপত্র প্রয়োজন হয় না।
- যদিও প্রচলিত এনজিও লোনের সুদ ব্যাংক ঋণের চেয়ে বেশি হতে পারে, তবে সরকারের প্রণোদনা বা বিশেষ প্রকল্পের আওতায় কম সুদে ঋণ পাওয়া সম্ভব।
- আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর দ্রুত ঋণ পাওয়া যায়, যা জরুরি প্রয়োজনে খুব সহায়ক।
- সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ থাকে, যা দরিদ্র মানুষের জন্য সুবিধাজনক।
- এই ঋণ দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের, বিশেষ করে নারীদের, স্বাবলম্বী হতে এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে।
- অনেক এনজিও ঋণ বীমা সুবিধা প্রদান করে, যেখানে ঋণ গ্রহীতা মারা গেলে অবশিষ্ট ঋণ মওকুফ করা হয়। এছাড়া, কিছু এনজিও জীবন বীমা বা অন্যান্য নিরাপত্তা তহবিল সুবিধা প্রদান করে।
- অনেক এনজিও ঋণ প্রদানের পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন, কারিগরি সহায়তা এবং ব্যবসা পরিচালনার প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যা উদ্যোক্তাদের সফল হতে সাহায্য করে।
কম সুদে এনজিও ঋণ পাওয়ার টিপস
- এনজিওগুলো সাধারণত সদস্য গঠন করে গ্রুপের মাধ্যমে ঋণ দেয়।
- আগের ঋণ যদি সময়মতো পরিশোধ করা থাকে, তাহলে আবার সহজে লোন মেলে এবং সুদের হার কমে যেতে পারে।
- সরকার অনুমোদিত এমএফআই (MRA তালিকাভুক্ত) এনজিও বেছে নিন।
- স্থানীয় অফিসে যোগাযোগ করে প্রকল্পভিত্তিক বিশেষ কম সুদের অফার জানতে চান।
- নারী উদ্যোক্তা, প্রতিবন্ধী, কিংবা পরিবেশবান্ধব উদ্যোগের জন্য বিশেষ ছাড় পাওয়া যেতে পারে।
কম সুদে এনজিও লোন পাওয়ার জন্য সঠিক তথ্য জেনে এবং সংশ্লিষ্ট এনজিওর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে বিস্তারিত জানলে সবচেয়ে ভালো হয়।
লেখকের শেষ মতামত
কম সুদে এনজিও লোন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আশীর্বাদস্বরূপ, যা তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
তবে, ঋণ নেওয়ার আগে সুদের হার, শর্তাবলী এবং পুনঃপরিশোধের সময়সীমা ভালোভাবে বিবেচনা করা উচিত। সঠিক পরিকল্পনা এবং ঋণের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করলে এটি আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে সহায়ক হবে। আপনার যদি কম সুদে এনজিও লোন নেওয়ার প্রয়োজন হয়, তবে আপনার এলাকার এনজিও শাখাগুলোতে যোগাযোগ করে বিস্তারিত তথ্য নিতে পারেন।