বর্তমান ডিজিটাল যুগে, আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংরক্ষিত থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন ব্যাংকিং, ই-কমার্স, ক্লাউড স্টোরেজসহ নানা ধরনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের তথ্য ভাগ করে নিচ্ছি।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকি অনেক। হ্যাকিং, ফিশিং, ম্যালওয়্যার এবং ডেটা লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলি ব্যক্তিগত তথ্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এর ফলে আর্থিক ক্ষতি, সম্মানহানি, এবং সাইবার বুলিংয়ের মতো সমস্যা হতে পারে।
বর্তমান যুগে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের সাথে সাথে ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ই-কমার্স সাইট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, অনলাইন ব্যাংকিং এবং সরকারি সেবাসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করা হচ্ছে। তবে, এই সুবিধার পাশাপাশি ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলো কী, কীভাবে এই ঝুঁকিগুলো সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব, এবং এই ঝুঁকি মোকাবেলায় আমাদের করণীয়।
ডিজিটাল মাধ্যমের ঝুঁকি কি কি
ডিজিটাল মাধ্যমে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সাইবার আক্রমণ (যেমন হ্যাকিং, ফিশিং, ম্যালওয়্যার), ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার, অনলাইনে হয়রানি, এবং সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব।
ডিজিটাল মাধ্যমের ঝুঁকিগুলি সাধারণত নিম্নলিখিতভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়:
➡️সাইবার ঝুঁকি:
- হ্যাকিং: unauthorized বা অননুমোদিতভাবে কারো ডিজিটাল ডিভাইস বা নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে তথ্য চুরি, পরিবর্তন বা ধ্বংস করা।
- ফিশিং: ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ব্যবহারকারীর নাম, পাসওয়ার্ড, ক্রেডিট কার্ডের বিবরণ ইত্যাদি প্রতারণামূলক উপায়ে সংগ্রহ করা।
- ম্যালওয়্যার: ক্ষতিকারক সফটওয়্যার (যেমন ভাইরাস, ওয়ার্ম, ট্রোজান) যা ডিভাইসের কার্যকারিতা হ্রাস করে বা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে।
- র্যানসমওয়্যার: ব্যবহারকারীর ফাইল এবং ডেটা অ্যাক্সেস ব্লক করে মুক্তিপণের জন্য ব্যবহার করা।
- সাইবার হয়রানি: অনলাইনে কাউকে ভয় দেখানো, অপমান করা, বা মানসিকভাবে নির্যাতন করা।
➡️তথ্য-সংক্রান্ত ঝুঁকি:
- গোপনীয়তা লঙ্ঘন: ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল তথ্য (যেমন আইডি, ব্যাংক একাউন্ট, ইত্যাদি) অননুমোদিত ব্যক্তিদের কাছে প্রকাশ করা।
- মিথ্যা বা ভুল তথ্য: ইন্টারনেটে ভুল বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো, যা ব্যক্তি বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
➡️মানসিক ও সামাজিক ঝুঁকি:
- আসক্তি: ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আসক্তি হওয়া, যা ব্যক্তিজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: অনলাইন কার্যকলাপের কারণে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া হ্রাস হওয়া।
- মানসিক চাপ: অনলাইন বুলিং বা সাইবার হয়রানির কারণে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ বৃদ্ধি পাওয়া।
- তুলনা এবং হীনমন্যতা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অন্যদের জীবনযাত্রার সাথে নিজের জীবনকে তুলনা করে হীনমন্যতায় ভোগা।
➡️শারীরিক ঝুঁকি:
- দৃষ্টিশক্তির সমস্যা: দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকার কারণে চোখের সমস্যা হওয়া।
- শারীরিক কষ্টের সৃষ্টি: দীর্ঘ সময় বসে থাকার কারণে ঘাড়, কোমর বা হাতে ব্যথা হতে পারে।
- ঘুমের সমস্যা: ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করতে পারে।
ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারের সময় এই ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকি
বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আমরা দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরণের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করি—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন ব্যাংকিং, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ব্যবসা, এমনকি সরকারি সেবা গ্রহণেও। এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের সময় আমরা আমাদের নানা রকম ব্যক্তিগত তথ্য যেমন—
- নাম,
- ঠিকানা,
- মোবাইল নম্বর,
- জন্মতারিখ
- জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর,
- ব্যাংক হিসাব নম্বর ও কার্ড তথ্য
- পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স
- বায়োমেট্রিক তথ্য (আঙুলের ছাপ, মুখের ছবি)
- অবস্থান তথ্য (location data)
- স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য
- অনলাইন অ্যাকাউন্টের লগইন তথ্য
- অবস্থান ইত্যাদি
এই তথ্যগুলো যদি সুরক্ষিত না থাকে, তাহলে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকি অনেক। হ্যাকিং, ফিশিং, ম্যালওয়্যার এবং ডেটা লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলি ব্যক্তিগত তথ্যকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এর ফলে আর্থিক ক্ষতি, সম্মানহানি, এবং সাইবার বুলিংয়ের মতো সমস্যা হতে পারে।
১। ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ
1️⃣দুর্বল পাসওয়ার্ড এবং অ্যাকাউন্ট সুরক্ষা
- দুর্বল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা এবং একই পাসওয়ার্ড প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা।
2️⃣সাইবার সিকিউরিটি জ্ঞানের অভাব
- অনেক ব্যবহারকারী ফিশিং, ম্যালওয়্যার বা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে সচেতন নন।
3️⃣ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা
- কোম্পানিগুলো পর্যাপ্ত এনক্রিপশন, ফায়ারওয়াল বা ডেটা প্রোটেকশন পলিসি প্রয়োগ না করলে ডেটা লিক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
২। ব্যক্তিগত তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির প্রভাব
1️⃣আর্থিক ক্ষতি
- ব্যবহারকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে যথা অননুমোদিত লেনদেন, ক্রেডিট কার্ড ফ্রড এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং।
2️⃣ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব
- ব্যক্তিগত ছবি, বার্তা বা তথ্য লিক হলে সামাজিক সম্মানহানি, ব্ল্যাকমেইল বা মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে।
3️⃣ব্যবসায়িক ক্ষতি
- কোম্পানিগুলো ডেটা ব্রিচের কারণে গ্রাহকের আস্থা হারায় এবং আইনি জরিমানার শিকার হয়।
4️⃣জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি
- সরকারি প্রতিষ্ঠান বা গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হ্যাক হলে জাতীয় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
➡️ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকিগুলো হলো:
1️⃣ফিশিং:মিথ্যা ইমেইল বা লিংকের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে প্রতারণার মাধ্যমে লগইন তথ্য, ওটিপি বা কার্ড ডিটেইলস দিতে বাধ্য করা হয়।
2️⃣ম্যালওয়্যার: ম্যালওয়্যার এক ধরণের ক্ষতিকর সফটওয়্যার যা ডিভাইসে প্রবেশ করে তথ্য চুরি, সিস্টেমে ত্রুটি তৈরি বা কম্পিউটারের ক্ষতি করতে পারে।
3️⃣ডেটা লঙ্ঘন:কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ডেটাবেস থেকে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে তাকে ডেটা লঙ্ঘন বলা হয়। এর ফলে ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ হয়ে যেতে পারে।
4️⃣সামাজিক প্রকৌশল: সামাজিক প্রকৌশল হলো ব্যবহারকারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য বা সিস্টেম অ্যাক্সেস পাওয়ার একটি প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, একজন হ্যাকার হয়তো কারো সাথে বন্ধুত্ব করে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
এই ঝুঁকিগুলো থেকে বাঁচতে, ব্যবহারকারীদের শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা, ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা, অপরিচিত লিঙ্ক বা এটাচমেন্টে ক্লিক না করা এবং নিয়মিত অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা উচিত।
৩। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম কীভাবে তথ্য সংগ্রহ করে?
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহারকারীদের তথ্য সংগ্রহ করে, যেমন:
- রেজিস্ট্রেশন বা সাইন-আপ: ইউজার অ্যাকাউন্ট তৈরির সময়।
- কুকিজ ও ট্র্যাকিং স্ক্রিপ্ট: ওয়েবসাইট বা অ্যাপে ব্রাউজ করার সময়।
- অ্যাপ পারমিশন: মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারের সময় ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, লোকেশন ইত্যাদির অনুমতি।
- অনলাইন লেনদেন: ক্রয়-বিক্রয়ের সময়।
- সামাজিক মাধ্যম: পোস্ট, লাইক, কমেন্টের মাধ্যমে।
- আইওটি ডিভাইস: স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ, স্মার্ট হোম ডিভাইস।
৪। ব্যক্তিগত তথ্য ঝুঁকির মুখে কেন?
1️⃣হ্যাকিং ও সাইবার আক্রমণ: সাইবার অপরাধীরা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার জন্য ওয়েবসাইট বা সার্ভারে হ্যাকিং করে। তথ্য চুরি করে তারা ব্ল্যাকমেইল, প্রতারণা বা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করে।
2️⃣ফিশিং আক্রমণ: মিথ্যা ইমেইল বা লিংকের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে প্রতারণার মাধ্যমে লগইন তথ্য, ওটিপি বা কার্ড ডিটেইলস দিতে বাধ্য করা হয়।
3️⃣ডেটা ব্রিচ: বড় প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে নিরাপত্তাজনিত ত্রুটি থাকলে একসাথে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
4️⃣ম্যালওয়্যার ও স্পাইওয়্যার: ভুয়া অ্যাপ বা সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ডিভাইসে ম্যালওয়্যার প্রবেশ করিয়ে তথ্য চুরি করা হয়।
5️⃣সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং: মানুষকে ঠকিয়ে বা ভুল বুঝিয়ে তার কাছ থেকে তথ্য আদায় করার একটি কৌশল।
➡️ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁসের পরিণতি
- আর্থিক ক্ষতি: ব্যাংক তথ্য চুরি হয়ে গেলে অর্থ চুরি হতে পারে।
- মানসিক চাপ ও সামাজিক সম্মানহানি: ব্যক্তিগত ছবি বা মেসেজ ফাঁস হয়ে গেলে তা মানসিক আঘাত বা হেয় প্রতিপন্ন করতে পারে।
- চাকরি বা শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যা: ফাঁস হওয়া তথ্যের কারণে কর্মস্থলে বদনাম হতে পারে।
- রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি: অনেক ক্ষেত্রে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ থাকলেও এটি মূলত সাইবার অপরাধ দমনকেন্দ্রিক। ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় একটি স্বতন্ত্র আইন প্রয়োজন।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকার “ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন” খসড়া করেছে, তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি। তাছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান যথাযথ সাইবার সিকিউরিটি মেনে চলে না।
✅ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষার উপায়
➡️ব্যক্তি পর্যায়ে করণীয়:
- মজবুত পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন – সংখ্যা, বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, ও প্রতীক মিলিয়ে।
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন চালু রাখুন – লগইনের সময় অতিরিক্ত সিকিউরিটি স্তর যুক্ত হয়।
- সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক করবেন না – ফিশিং অ্যাটাক থেকে সতর্ক থাকুন।
- ভুয়া ওয়েবসাইট এড়িয়ে চলুন – কেবল নিরাপদ এবং পরিচিত সাইট ব্যবহার করুন।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে সতর্কতা – নিজের জন্ম তারিখ, মোবাইল নম্বর, অবস্থান এসব কম শেয়ার করুন।
- নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট করুন – নিরাপত্তা দুর্বলতা দূর হয়।
➡️প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে করণীয়:
- তথ্য এনক্রিপশন ব্যবহার করা
- ISO সার্টিফাইড সিকিউরিটি ব্যবস্থা গ্রহণ
- ডেটা ব্রিচ প্ল্যান থাকা
- কর্মীদের সাইবার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ দেওয়া
- ব্যবহারকারীর সম্মতি ছাড়া তথ্য ব্যবহার না করা
- ডেটা মিনিমাইজেশন অনুসরণ করা
➡️রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয়:
- একটি পূর্ণাঙ্গ “ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন” প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- “ডেটা প্রোটেকশন অথরিটি” গঠন
- জনগণের ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো
- সরকারি ওয়েবসাইট ও সার্ভারের সুরক্ষা জোরদার করা
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমাদের জীবন সহজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র—সকল পর্যায়ে সচেতনতা ও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নিরাপদ ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে এখনই সময় যথাযথ নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়ার।
ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সংঘটিত অপরাধ
ডিজিটাল মাধ্যমে তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সংঘটিত অপরাধ বলতে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা লঙ্ঘন এবং অপরাধকে বোঝায়। এই অপরাধগুলির মধ্যে রয়েছে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি, হ্যাকিং, সাইবার বুলিং, এবং আর্থিক জালিয়াতি।
তথ্য নিরাপত্তা ঝুঁকি:
- ব্যক্তিগত তথ্যের চুরি: অনলাইনে বিভিন্ন তথ্য যেমন নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ইমেল আইডি, ব্যাংক একাউন্ট এর তথ্য চুরি হতে পারে।
- সাইবার বুলিং: অনলাইনে কাউকে উদ্দেশ্য করে অপমানজনক বা আপত্তিকর মন্তব্য করা বা হয়রানি করা সাইবার বুলিং এর অন্তর্ভুক্ত।
- ফিশিং: ফিশিং এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ব্যক্তিগত তথ্য যেমন ইউজার আইডি, পাসওয়ার্ড, বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়।
- ম্যালওয়্যার আক্রমণ: ম্যালওয়্যার (যেমন ভাইরাস, ট্রোজান হর্স) ডিভাইসে প্রবেশ করে ডেটা ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে বা সংবেদনশীল তথ্য চুরি করতে পারে।
- র্যানসমওয়্যার:
- এই ধরণের ম্যালওয়্যার ব্যবহারকারীর ফাইল বা সিস্টেমে অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেয় এবং এটি পুনরুদ্ধারের জন্য মুক্তিপণ দাবি করে।
- সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং: হ্যাকাররা ব্যবহারকারীদের ম্যানিপুলেট করে তাদের থেকে তথ্য আদায় করে।
সংঘটিত অপরাধ:
- হ্যাকিং এবং ডেটা চুরি।
- ব্যাংক একাউন্ট থেকে অর্থ চুরি বা জালিয়াতি।
- সাইবার বুলিং এবং হয়রানি।
- শিশুদের পর্নোগ্রাফি বা অন্যান্য সাইবার অপরাধ।
- বিভিন্ন ধরণের অনলাইন জালিয়াতি।
- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা।
করণীয়:
- অপরিচিত লিঙ্ক বা ইমেল এ ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন।
- পাসওয়ার্ড শক্তিশালী করুন এবং নিয়মিত পরিবর্তন করুন।
- ২FA (Two-Factor Authentication) ব্যবহার করুন।
- সফটওয়্যার এবং অপারেটিং সিস্টেম আপ-টু-ডেট রাখুন।
- সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপনার গোপনীয়তা সেটিংস পর্যালোচনা করুন।
- আপনার ডিভাইস এবং নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখতে অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।
- অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার পরিহার করুন।
- এই বিষয়গুলো মনে রেখে ডিজিটাল মাধ্যমে নিরাপদ থাকা সম্ভব।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ থাকার কার্যকর পদক্ষেপ
ইন্টারনেট, যেখানে শিক্ষা এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ দেয়, সেখানে সাইবার বুলিং, অপ্রাসঙ্গিক কনটেন্ট, গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং অনলাইন শিকারীর মতো বিপদও রয়েছে। আজকের ডিজিটাল যুগে, তরুণরা স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্রমাগত সংযুক্ত হচ্ছে।
ঝুঁকি বোঝা
টিনএজাররা সাধারণত প্রতিদিন টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ও স্ন্যাপচ্যাটের এর মতো প্ল্যাটফর্মে সময় কাটায়, যা তাদের বিভিন্ন অনলাইন ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে সাইবারবুলিং এবং ক্ষতিকারক কনটেন্টে এক্সপোজারের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
অনলাইনে অজান্তে শেয়ার করা ব্যক্তিগত তথ্য বা পরিচয় চুরিরও সম্ভাবনা রয়েছে। এই কারণে, অভিভাবকদের সন্তানদের অনলাইন অভিজ্ঞতার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হওয়া জরুরি।
মানসিক সুস্থতায় সমর্থন
নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যের বাইরে, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো মানসিক সুস্থতা প্রচারে গুরুত্ব দেয়। যেমন, বিরতি নেওয়ার রিমাইন্ডার বা রাতে শোয়ার আগে লগ আউট করার প্রম্পট ব্যবহারকারীদের সুস্থ ডিজিটাল অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
শিক্ষা ও সহযোগিতা
অনলাইন নিরাপত্তায় প্রযুক্তির পাশাপাশি শিক্ষাও সমানভাবে জরুরি। অভিভাবক ও শিক্ষকদের উচিত তরুণদের শেখানো কীভাবে ইন্টারনেটে দায়িত্বশীলভাবে চলাফেরা করতে হয় — যেমন অশালীন কনটেন্ট চিনে নেওয়া, অতিরিক্ত তথ্য শেয়ার না করা, বা প্রাইভেসি সেটিংস বোঝা।
কিভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিরাপদ থাকবেন?
- ✔ দুই স্তরের নিরাপত্তা (2FA) চালু করুন – আপনার গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা দ্বিগুণ হবে।
- ✔ শক্তিশালী ও আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন – সহজ অনুমানযোগ্য পাসওয়ার্ড এড়িয়ে চলুন।
- ✔ নির্ভরযোগ্য সফটওয়্যার ও অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন – ম্যালওয়্যার ও ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে এটি জরুরি।
- ✔ অপরিচিত লিঙ্ক ও ইমেইল এড়িয়ে চলুন – সন্দেহজনক ওয়েবসাইট বা ইমেইল ক্লিক না করাই ভালো।
- ✔ VPN ব্যবহার করুন – পাবলিক ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সময় আপনার তথ্য এনক্রিপ্ট করে রাখবে।
- ✔ ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণে সচেতন হোন – সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতিরিক্ত তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
এছাড়া সন্দেহজনক লিংক এবং মেসেজ থেকে দূরে থাকুন। কোনও অজানা লিংক বা মেসেজে ক্লিক করবেন না। শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ ওয়াইফাই ব্যবহার করুন। অ্যান্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন এবং তা আপডেট রাখুন।
বিশ্ব ব্যাংকের উই-ফি প্রকল্পের আওতায় ওমেন এন্ট্রেপ্রেনিউরস বিসনেস সাপোর্ট সেন্টার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বিনা মূল্যের সহায়তা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। নারী উদ্যোক্তারা তাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় যেকোনও ধরনের পরামর্শ নিতে পারেন। আপনার ব্যবসাকে সুরক্ষিত রাখতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারবেন।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে করণীয়
✅অনেকেই নতুন কোনো বন্ধু তৈরি করতে গিয়ে বিপদে পড়েন। বন্ধুর রূপ ধরে আসে ক্ষতিকর কেউ। কিন্তু তারা তা আগেভাগে বুঝতে পারেন না। তাই অনলাইনে অপরিচিত কারও সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সতর্ক হোন। ভালোভাবে না জেনে কাউকে বন্ধু করতে যাবেন না।
✅অনেকেই ফিশিং-এর পাল্লায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এক্ষেত্রে ফিশিং থেকে রক্ষা পেতে চাইলে ইমেইল কিংবা মেসেজে পাওয়া কোনো লিংকে ক্লিক করবেন না। কোনো ধরনের প্রলোভনেও পড়বেন না। নয়তো পরবর্তীতে আপনিই বিপদে পড়বেন।
✅ব্যক্তিগত একাউন্টের ক্ষেত্রে ‘প্রাইভেসি সেটিংস বা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়াসমূহ’ চালু করে রাখবেন।
✅ম্যালওয়ার/র্যনসমওয়ার জাতীয় ক্ষতি থেকে বাঁচতে নিয়মিত তথ্য সংরক্ষণ (ডাটা ব্যাক-আপ) করতে হবে। পাশাপাশি ডিভাইসের সুরক্ষায় আপডেটেড এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে।
✅যেকোনো তথ্য, ফাইল কিংবা নতুন আপডেট ডাউনলোডের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবেন। উৎসের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে তবেই ডাউনলোড করুন।
✅আপডেট করা হয়েছে এমন এন্টি-ভাইরাস ব্যবহার করার মাধ্যমে ডিভাইসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
ডিজিটাল যুগে ব্যক্তিগত তথ্য ও তার সুরক্ষা
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন নাগরিক বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে; তেমনই প্রাইভেট কোম্পানিগুলোও তাদের ভোক্তাদের তথ্য, নাম, ঠিকানা, আইডি নম্বর, জন্মতারিখ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে থাকে ইন্টারনেট কিংবা ইন্টারনেট সংযুক্ত মাধ্যমগুলোয়। এ ধরনের তথ্য হ্যাকারদের কাছে মূল্যবান।
সেটি দিয়ে কত রকম অবৈধ সুবিধা নেওয়া যায়, সেটি সাধারণভাবে চিন্তার বাইরে। আবার সেসব তথ্য দিয়ে ছোট থেকে বড় আকারের ব্যবসাও পরিচালনা করতে পারে। আপনার নামে ব্যাংক লোন হতে পারে। আবার ইন্টারনেটনির্ভর আর্থিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি সাইবার হামলার শিকার হয়।
কারণ সেখানে আর্থিকভাবে লাভবান বেশি হয় হ্যাকাররা। যাদের আমরা বলে থাকি এপিটি বা অ্যাডভান্সড পারসিসটেন্ট থ্রেট। যে কোনো ভাবে এই সাইবার হামলা ঠেকানো না গেলে বাংলাদেশের জন্য এর প্রভাব আরও প্রকট হয়ে পড়বে।
সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস হওয়া থেকেই এটি সহজে বোঝা যায়। সেজন্য এই ডিজিটাল যুগে এসে সাইবার নিরাপত্তাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা বা আর্থিক লেনদেন করতে হলে সর্বপ্রথম সাইবার নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। ব্যবহারকারীর সার্ভার, কম্পিউটার ও অন্য নেটওয়ার্ক অবকাঠামোগুলোয় নিয়মিত দুর্বলতা খুঁজে বের করতে হবে।
আর সাইবার নিরাপত্তার জোরদার করতে, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাইবার সিকিউরিটি সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা যেমন জরুরি, যেমন বিভিন্ন অবকাঠামোগুলোর দুর্বলতা সাইবার হামলার পূর্বেই খুঁজে বের করাও আবশ্যক।
লেখকের শেষ মতামত
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমাদের জীবন সহজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। এই ঝুঁকি থেকে বাঁচতে হলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র—সকল পর্যায়ে সচেতনতা ও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নিরাপদ ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে এখনই সময় যথাযথ নীতিমালা ও ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়ার।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা একটি জটিল ও ক্রমবর্ধমান সমস্যা। ব্যবহারকারী, কোম্পানি এবং সরকার—সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন এই ঝুঁকি মোকাবিলায়। প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে যাতে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত থাকে।