ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক বৈধ পশু-পাখি জবাইয়ের নিয়ম ও পদ্ধতি রয়েছে। সে অনুযায়ী পশু-পাখি জবাই করা উত্তম। আর একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেক কাজে ইসলামি নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। তাই পশু-পাখি জবাইয়ের পূর্বে জেনে নিতে হবে জবাইয়ের নিয়ম কি।
আমাদের আজকের আর্টিকেলের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে গরু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া এবং ছাগল জবাই করার নিয়ম সম্পর্কে। আমাদের আজকের আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে জেনে যাবেন গরু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া, ছাগল জবাই করার নিয়ম ও দোয়া, কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম, মুরগি জবাই করার নিয়ম এবং পশু জবাইয়ের সময় মাথা কোনো দিকে থাকবে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
গরু জবাই করার নিয়ম ও দোয়া
পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের ইসলাম ধর্মে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। সে নিয়মগুলো অনুসরন করে সবাইকে গরু জবাই করতে হবে। তবে আমাদের সমাজে এরম বহু মানুষ রয়েছেন যারা গরু জবাইয়ের ক্ষেত্রে নিয়মের প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ নিয়মগুলো মানা আমাদের রাসুল (সা.) দেওয়া দিকনির্দেশনা। তাহলে চলুন জেনে নিন গরু জবাই করার নিয়ম ও দোয়ার সম্পর্কে।
গরু জবাইয়ের নিয়ম:
১. গরু জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলে ছুড়ি চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া।
২. গরু কিংবা যেকোনো পশু জবাইয়ের পূর্বে পশুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে হবে। যাতে পশুটি জবাই করার সময় অধিক কষ্ট না পায়। আর এজন্য গরু জবাইয়ের সময় ছুরি দিয়ে যাতে ভালোভাবে কাটা যায় সেজন্য ছুরিতে ধার দিয়ে নেওয়া। এতে করে পশুর কষ্ট কম হয়। হাদিস থেকে বর্নিত- আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, পশু জবেহ করার আগে ছুরিতে ভালোভাবে ধার দিয়ে নেওয়া’। (মুসলিম)
৩. একাধিক পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে, এক পশু জবাই অন্য পশুর সামনে করা উচিত নয়। এটি আমাদের প্রিয় নবী (সা.) অপচ্ছন্দ করতেন।
৪. গরু জবাইয়ের পূর্বে, গরুর সামনে অস্ত্র ধারালো না করা।
৫. জবাই করার সময় একটি বিষয়ের দিকে নজর রাখতে হবে আর সেটি হলো- গরুর কন্ঠনালী, খাদ্যনালী এবং উভয় পাসের দুটি রগ যেন কাটে। এগুলো কাটা হয়ে গেলেই গরু জবাই বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবেন এগুলো কাটাই যথেষ্ট, খেয়াল রাখবেন যাতে গরুর শরীর থেকে মাথা বিছিন্ন না হয়।
৬. গরু জবাই করার সময়, গরুর বাম কাতে শোয়াতে হবে এবং সে সময় গরুর পাগুলো পশ্চিম দিকে থাকবে।
গরু জবাইয়ের দোয়া: মহান আল্লাহ তায়ালার নাম মুখে উচ্চারন করে পশু-পাখি জবাই করা ওয়াজিব এবং করণীয় বিষয়। কোরবানি ব্যতিত অন্য সময়ে যদি আপনি গরু জবাই করেন তাহলে সেক্ষেত্রে আল্লাহর নাম নিয়ে শুধুমাত্র-বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার’ বলে গরু জবাই করলে জবাই কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। তবে বিসমিল্লাহি ওয়াল্লহু আকবার’ বলার পর অতিরিক্ত হিসেবে বলতে পারেন,
উচ্চারণ: আল্লহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নী’।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার তরফ থেকে তা কবুল করুন।
ছাগল জবাই করার নিয়ম
যেকোনো কাজ ইবাদতের সাথে এবং আমাদের প্রিয় নবী রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ অনুসারে করা অপরিহার্য। রাসুল (সা.) যেভাবে সুন্নাহ মোতাবেক চলাফেরা করতেন সেইভাবে তিনি তার উম্মাহদেরও চলার আদেশ দিয়েছেন। তাহলেই আমরা সত্যের পথে এগোতে পারবো। তাই একজন মুমিন হিসেবে আমাদের সেভাবেই চলাফেরা করতে হবে। প্রত্যেক পশু-পাখি জবাইয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। ছাগল জবাইয়ের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক ছাগল জবাই করার নিয়ম সম্পর্কে।
প্রিয় পাঠক, আর্টিকেলের শুরুতে গরু জবাইয়ের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আর সে নিয়মগুলো একইভাবে ছাগল জবাইয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। গরু বা ছাগল যেকোনো পশু জবাই করুন না কেন এটি কোনো কঠিন পদ্ধতি নয়। কয়েকেটি বিষয়ের ওপর নজর দিলেই জবাই কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে। বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে প্রথমত বিসমিল্লাহ বলে ছুরি গলাই ধরতে হবে এবং এরপর আল্লহর নাম উচ্চারন করে জবেহ করতে হবে। আর খেয়াল রাখতে হবে পশু যাতে কোনোভাবেই কষ্ট না পায়। বিস্তারিত উপরের আলোচনা থেকে জেনে নিন।
ছাগল জবাই করার দোয়া
কুরবানির সময় ছাড়াও অনেকেই অনান্য সময়েও ছাগল জবাই করে থাকে। কোরবানির পশু জবাই যেমন নিয়ম ও দোয়া পড়ে করতে হয়। তেমনি ভাবে অনান্য সময়গুলোতে পশুপাখি জবায়ের কিছু নিয়ম ও দোয়া রয়েছে। দোয়া ছাড়া পশু-পাখি জবাই করে তা খাওয়া হালাল হবে না। তাই জেনে নিন ছাগল জবাই করার দোয়া সম্পর্কে।
ছাগল জবাই করার সময় মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা জরুরি। সেক্ষেত্রে বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার’ বলে ছাগল জবেহ করলেই, জবাই কৃত কাজ বিশুদ্ধ হয়ে যায়। এখানে অন্য কোনো দোয়া পড়ার প্রয়োজন নেয়। তবে কেউ চাইলে পড়ে পারেন- বিসমিল্লাহি ওয়াল্লহু আকবার, আল্লহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নী’।
কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম
কোরবানি ইসলাম ধর্মে খুবই গুরত্বপূর্ন একটি ইবাদত। এ ইবাদত মহান আল্লহর নিকট খুবই প্রিয়। রাসুল (সা.) নিজে কুরবানি করতেন এবং তিনি তার সকল উম্মাহকে যাদের সামার্থ্য রয়েছে তাদের এটি করার আদেশ দিয়েছেন। তাদের প্রতি রাসুল (সা.) হুঁশিয়ার উচ্চারন করেছেন যারা সামার্থ্য থাকার পরেও কোরবানি দেয় না।
সকল ইবাদত আমাদের সুন্নাহ মোতাবেক করা আবশ্যক। তাই কোরবানি আমাদের সে নিয়ম অনুসারে করতে হবে, যেভাবে আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) করে গেছেন। তো চলুন নি¤েœর আলোচনা থেকে জেনে নেওয়া যাক কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম সম্পর্কে।
১. হাদিস থেকে প্রমাণিত, নিজের কোরবানি নিজ হাতে করা মুস্তাহাব। রাসুল (সা.) নিজ কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করতেন। চেষ্টা করতে হবে নিজে দেওয়ার। তবে যদি নিজে না পারে তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করলেও কোরবানি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে নিজে দাড়িয়ে থেকে জবাই করে নেওয়া উত্তম হবে।
২. বিসমিল্লাহ’ বলে পশু জবেহ করা। অর্থ্যাৎ ছুরি চালানোর সময় বিসমিল্লাহ বলা।
৩. কোরবানি পশু জবাই করার সময় ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে যাতে জবেহ করার সময় পশুর শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং দুই পাশে থাকা দুটি নালী কাটা হয়। পশু জবেহ করা বিশুদ্ধ করতে এ নালীগুলো কাটা প্রয়োজন।
৪. কোরবানি করার সময় খেয়াল রাখতে হবে জবেহকৃত পশুটি যাতে কোনোভাবে কষ্ট না পায়। আর এজন্য ছুরিতে ভালোভাবে ধার দিয়ে নিতে হবে। এছারাও আরও অনান্য বিষয়গুলোতে পশু কষ্ট পায় যেমন-পশুর সামনে ছুরিতে ধার দেওয়া, একটি পশুর সামনে অপরপশু জবেহ করা ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. কোরবানির পশু জবাই করার সময় পশুকে কেবলার দিকে মুখ করে শোয়াতে হবে। এভাবে শোয়ানো ভালো, তবে অন্য মুখে শোয়ালেও কোরবানি হয়ে যাবে।
৬. কোরবানির পশু জবাইয়ের জন্য যখন পশুটিকে শোয়ানো হবে তখন দোয়া পড়া। দোয়াটি হলো-
উচ্চারণ: ইন্নি ওয়াঝঝাহতু ওয়াঝহিয়া লিল্লাজি ফাতারস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা আলা মিল্লাতি ইবরহিমা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন। ইন্না সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি জালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমিন। বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার, আল্লহুম্মা মিনকা ও লাকা।
৭. নিজের পশু নিজে কোরবানি করলে, পশু জবেহ শেষে এ দোয়া পড়া- উচ্চারণ: আল্লহুম্মা তাকব্বাললাহু মিন্নি কামা তাকব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খলিলিকা ইবরহিম।
৮. অন্য কারও পশু কোরবানি করলে সেক্ষেত্রে পড়বে- আল্লহুমা তাকব্বাললাহু মিনকা-মিনকুম কামা তাকব্বালতা মিন হাবিবিকা মুহাম্মাদিও ওয়া খলিলিকা ইবরহিম। ( দোয়াগুলো আরবি দেখে মুখস্থ করবেন)
এ দোয়াগুলো পড়ে কোরবানি করা উত্তম। তবে যদি কেউ শুধুমাত্র বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার’ বলে কোরবানির পশু জবেহ করে তাহলেও তার কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। এ সবকিছুর মধ্যে শুধুমাত্র বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার’ বলা ওয়াজিব। হাদিসে এটি বলে জবাই করার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর বাকি সব দোয়াগুলো পড়া মোস্তাহাব, জরুরি নয়।
মুরগি জবাই করার নিয়ম
পশু-পাখি জবাই করার ক্ষেত্রে ইসলামে কিছু সুনির্দিষষ্ট নিয়ম রয়েছে। সেগুলো অনুসরণ করে মুরগি জবাই করতে হবে। সকল ধরনের কাজ-কর্ম ইসলামি দিকনির্দেশা মোতাবেক করা প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। তাই জেনে নিন মুরগি জবাইয়ের সঠিক নিয়ম সম্পর্কে।
- মুরগি জবাই কারিকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।
- জবাইয়ের সময় খুবই ধারালো ছুরি বা যেকোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে, যাতে মুরগি কষ্ট না পায়।
- এক মুরগির সামনে অন্য মুরগি জবাই না করা।
- গলার রগ কাটা হয়ে গেলেই মুরগি কাটা বিশুদ্ধ হয়ে যাবে। খেয়াল রাখতে হবে মুরগি থেকে যাতে মাথা আলাদা না হয়। মুরগি যতক্ষন পর্যন্ত সম্পূর্ন নিস্তেজ না হয় ততক্ষন পর্যন্ত মুরগি ছেলা ও কাটা থেকে বিরত থাকা।
- বিসমিল্লহি ওয়াল্লহু আকবার’ বলে ছুরি চালাতে হবে। মনে রাখবেন যদি ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লহর নাম উচ্চরন না করে মুরগি জবাই করলে সে মুরগি খাওয়া হালাল হবে না।
সুতরাং মুরগি বাড়িতে জবাই করুন কিংবা বাজার থেকে জবাই করে আনুন খেয়াল রাখতে হবে তা সঠিক নিয়মে জবাই করা হয়েছে কি না।
পশু জবাই করার সময় মাথা কোন দিকে থাকবে
পশু-পাখি জবাই করার ক্ষেত্রে মাথা কোন দিকে থাকবে? কোন দিকে মাথা রেখে পশু জবাই করা সুন্নাহ পদ্ধতি জানেন কি? প্রত্যেক মুসলিম উম্মাহর উচিত সুন্নাহ পদ্ধতিতে চলাফেরা করা। তাই চলুন জেনে নিন পশু জবাই করার সময় মাথা কোন দিকে থাকবে।
পশু-পাখি জবাই করার ক্ষেত্রে, সে পশু যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন কোরবানি, আকিকা কিংবা অন্য কোনো কারণে সকল ক্ষেত্রে পশু জবাইয়ের সময় জবাইয়ের পশু-পাখির মাথা দক্ষিণে এবং পা উত্তর দিকে করে শোয়াতে হবে। এরপর কিবলার দিকে পশুর মাথা ও পা কাৎ করে রাখতে হবে। এ পদ্ধতিতে পশুর মাথা রাখা মুস্তাহাব। তবে এটি আবশ্যক কোনো বিষয় বা শর্ত নয়। তবুও এ নিয়মে জবাই করা ভালো।
তবে মনে রাখবেন পশ-পাখি জবাইয়ের সময় আবশ্যক ও জরুরি হলো বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর নাম উচ্চরন করা। সুতরাং বিসমিল্লাহি আল্লহু আকবার’ অবশ্যই বলতে হবে। মনে রাখবেন জবাইয়ের আগে যদি কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে আল্লাহ তায়ালার নাম না নিয়ে জবাই করে তাহলে সে পশু খাওয়া যায়েজ হবে না। পবিত্র আল-কুরআনের সুরা আনয়াম, আয়াত নং-১২১ বলা হয়েছে-যদি জবাইয়ের পূর্বে ইচ্ছাকৃতভাকে আল্লাহ তায়ালার নাম না বলে তাহলে উক্ত পশু খাওয়া জায়েয হবে না।
সুতরাং কোরবানির পশু কিংবা অনান্য সব পশু-পাখি সুন্নাত পদ্ধতি অনুসরণ করে জবাই করতে হবে। সুন্নাহ নিয়মে পশু-পাখি জবেহ করা উত্তম। মহান আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম উম্মাহকে সঠিক নিয়মে পশু-পাখি অথবা কোরবানির পশু জবাই করার তৌফিক দান করুন। আমিন’