ইসলামে আকিকা একটি গুরুত্বপূর্ন সুন্নাহ। তবে আমাদের সমাজে এ আকিকা নিয়ে অনেক ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেকের সঠিক নিয়ম জানা নেই জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয়। তাই আমরা এ ভ্রান্ত ধারনাগুলো দূর করতে আজকের আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করবো জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয় এ সম্পর্কে।
আমাদের আজকের আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে জেনে যাবেন জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয় এবং আকিকার সঠিক মাসআলা। একজন মুসলিম হিসেবে আকিকা বিষয়ে সঠিক তথ্য অবশ্যই আমাদের জেনে নিতে হবে। তো চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয় এবং আকিকার মাসআলা সম্পর্কে।
আকিকা করার নিয়ম
আমাদের পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন অত্যন্ত সুখের। সন্তান মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা আমাদের জন্য অনেক বড় একটি নেয়ামত। আমাদের মুসলিম পন্থা অনুযায়ী সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে আকিকার এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।
আকিকা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- আল্লাহর দরবারে নজরানা পেশ করা, জানের সদকা দেওয়া অথবা শুকরিয়া আদায় করা। সন্তান জন্মের পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে পশু জবাই করার প্রক্রিয়া হলো আকিকা। ছেলে কিংবা মেয়ে উভয় সন্তানের জন্য আকিকা করা উত্তম একটি কাজ। রাসুল সা. এর বলা কথা ও কাজের মাধ্যম দিয়ে আকিকা দেওয়ার নির্দেশনা পাওয়া যায়। তাই আকিকা প্রত্যেক সন্তান জন্ম দেওয়ার পর দেওয়া জরুরি। তবে আকিকা করার নিয়ম সম্পর্কে আমাদের অনেক মতোবিরোধ রয়েছে। তাই চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক আকিকা করার নিয়মগুলো সম্পর্কে।
*আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সা. আকিকা সম্পর্কে (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস নং: ৭৯৬১) হাদিসে বর্ননা করেছেন- যে ব্যক্তি সন্তানের আকিকা করার ইচ্ছা করে, সে যেন তা পালন করে। ছেলের জন্য সমমানের দুটি ছাগল আর মেয়ের জন্য একটি।
*আয়েশা রা. এর বর্ননাকৃত হাদিসে এসেছে-ছেলের পক্ষ থেকে প্রতিদান হিসেবে দুটি বকরি ও মেয়ের পক্ষ থেকে একটি বকরি আকিকা করা সুন্নত।
সুতরাং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিন, মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল এবং ছেলে সন্তানের জন্য দুটি ছাগল আকিকা করতে হবে। এটি হলো সত্যিকারের সুন্নাহ পদ্ধতি এবং নবী সা. এর নির্দেশনা। তবে সামার্থবান না হলে ছেলে সন্তানের জন্য একটি পশু দিয়েও আকিকা হয়ে যায়। তবে চেষ্টা করবেন দুটি পশু একবারে আকিকা না দিতে পারলে প্রথমে একটি এবং পরে আরেকটি দেওয়ার। তবে সামার্থ না থাকলে একটি দিলেও তার আকিকা আদায় হয়ে যাবে। (ইন শা আল্লহ’)
শুধু ছাগল নয়, উট, গাভী, দুম্বা, ভেড়া, মহিষ এ পশু গুলো দিয়ে আকিকা দেওয়ার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
আকিকা করার দায়িত্ব পালন করতে হবে সন্তান যিনি লালন পালন করবে অর্থ্যাৎ বাবাকে। আকিকার দায়িত্ব প্রথমে বাবার পালন করা উচিত। তবে বাবার যদি সে সময় আর্থিক অবস্থা না থাকে তাহলে বাবার পক্ষ থেকে মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি অথবা অন্য কেউ বাবার মত নিয়ে আকিকা দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। (আকিকা দেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পুরো আর্টিকেলটি আপনাকে পড়তে হবে)
জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয়
সন্তান জন্মের পর আকিকা দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি সুন্নাহ পদ্ধতি। আর একজন মুসলিম হিসেবে সবার উচিত সন্তান জন্ম হলে ইসলামী নির্দেশ অনুযায়ী আকিকা করা। তবে ইসলামে আকিকার সঠিক নিয়ম কি? সন্তান জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয় এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় পড়ে যায়। তো চলুন জেনে নিন জন্মের কতদিন পর আকিকা দিতে হয়।
সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সপ্তম দিনে আকিকা করা সবথেকে উত্তম। সুন্নাহ অনুযায়ী সপ্তম দিনে আকিকা দিতে হবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং: ২৮৩৪) থেকে বর্নিত- আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর দুই নাতী হাসান ও হুসাইন (রা.) এর আকিকা সপ্তম দিনে করেছেন। তিরমিজির এক হাদিস নং ১৫২২ তে সপ্তম দিনে আকিকা দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই সপ্তম দিনে আকিকা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তাই আমরা চেষ্টা করবো রাসূল (সা.) এর করণীয় কাজগুলোর উপর আমল করার, আর তা আকিকার বিষয়েও।
তবে জরুরি কোনো কারণে সপ্তম দিনে যদি আকিকা দিতে না পারে তাহলে ১৪তম দিনে অথবা ২১তম দিনে আকিকা করা ভালো। উম্মল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন-আকিকা সপ্তম দিনে হওয়া উচিত। তা সম্ভব না হলে চৌদ্দতম দিনে, তাও সম্ভব না হলে একুশতম দিনে। (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ৭৬৬৯)
আকিকার দিন গননার নিয়ম জেনে নিন: আলেমদের মত অনুযায়ী যে বারে শিশু জন্মগ্রহন করবেন তার পরবর্তী সপ্তাহের আগের বার হবে শিশুর জন্মের সপ্তম দিন। ধরুন আপনার শিশু শুক্রবারের দিনে জন্মগ্রহন করেছে তাহলে সপ্তম দিন হবে পরবর্তী সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন। আর যদি শুক্রবার সূর্যাস্তের পর জন্ম নেয় সেক্ষেত্রে দিন গননা শুরু হবে শনিবার থেকে। তাহলে সপ্তমদিন হবে পরের শুক্রবার।
সুতরাং আকিকা সপ্তম দিনে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আধুনিক চিকিৎসা অনুযায়ী আমরা আগে থেকেই ধারনা পেয়ে যায় সন্তান কখন পৃথিবীতে আসবে। একজন মা যখন গর্ভবতী হয় তখন লম্বা একটা সময় পর সন্তান পৃথিবীতে আসে। তাই আমাদের আগে থেকেই সন্তান আকিকা করার পরিকল্পনা করতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে সপ্তম দিনে দেওয়ার।
আকিকার জন্য ছাগলের বয়স
সন্তান জন্মের পর প্রত্যেক বাবার উচিত সন্তানের আকিকা করা। আমাদের প্রিয় নবী রাসুল (সা.) বলেছেন-সব শিশু তার আকিকার সাথে দায়বদ্ধ অবস্থায় থাকে। সন্তান জন্মের সাত দিনের দিন তার পশু জবাই করতে হবে, তার নাম রাখতে হবে এবং তার মাথা মুন্ডন করে দিতে হবে। তাই আমাদের সবার উচিত সন্তানের আকিকা করা।
আকিকার কিছু নিয়ম রয়েছে যেগুলো আকিকা করার আগে জেনে নিতে হবে। নিয়মগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ন একটি নিয়ম হলো- সঠিক পশু বা ছাগল আকিকার জন্য নির্বাচন করা। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক আকিকার জন্য ছাগলের বয়স কত হতে হবে।
আকিকার ছাগল তেমন হতে হবে যেমন কুরবানীর ছাগল হবে। যেসব পশু দিয়ে কোরবানি নিষিদ্ধ সেসব পশু দিয়ে আকিকাও আদায় হবে না। তাই আকিকার জন্য ছাগলের বয়স সর্বনি¤œ এক বছর হতে হবে। তবে অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন এক বছরের কম বয়সের ছাগল দিয়ে আকিকা করা যাবে কি না। সেক্ষেত্রে বলতে চাই জায়েজ আছে তবে শর্ত হলো ছাগলের বয়স এক বছরের কাছাকাছি এবং সুস্থ ও মোটাতাজা দেখতে এক বছরের ছাগলের মতই। এটি হলো রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ পদ্ধতি।
আকিকার গোশত বন্টনের নিয়ম
আকিকা মুসলিমদের ইবাদতের একটি অংশ। ইসলামে আকিকার বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে সেগুলো সঠিক ভাবে জেনে আমাদের সন্তানের আকিকা করতে হবে। সে নিয়মগুলোর মধ্যে একটি হলো আকিকার গোশত বন্টনের নিয়ম। জানেন কি? আকিকার গোশত বন্টনের নিয়ম কি। বিস্তারিত জেনে নিন-
আকিকার গোশত আপনি দুই পদ্ধতিতে মানুষের মাঝে পৌঁছাতে পারেন। এক. হলো কাঁচা হাদিয়া হিসাবে এবং দুই. রান্না করে। সুতরাং আকিকার গোশত আপনি চাইলে আকিকার মাংস থেকে নিজের জন্য রাখুন, গরিবদের সদকা করুন এবং আত্বীয়স্বজন বন্ধু বান্ধবকে দিন। যে নিয়মে কুরবানির মাংস বন্টন করেন।
আবার অনেক আলেমদের মতে আকিকার গোশত কাঁচা না দিয়ে তা রান্না করে পাড়া প্রতিবেশি ও গরীবদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া অথবা দাওয়াত করে খাওয়ানো মুস্তাহাব। এ কাজটিও প্রসংশনীয়। তবে মনে রাখবেন দাওয়াতের আয়োজন করলে অবশ্যই সে দাওয়াতে শুধু আত্বীয়রা থাকলেই হবে না, গরীব-মিসকিন সবাইকে শরীক করাতে হবে।
আকিকার মাংস কারা খেতে পারবে
আকিকার মাংস খাওয়া নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের কথা বলে থাকেন। কারা খেতে পারবে কারা খেতে পারবে না এ নিয়ে সমাজে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। তাই চলুন সঠিক তথ্য জেনে নেওয়া যাক আকিকার মাংস কারা খেতে পারবে।
আকিকার গোশত সন্তানের মা-বাবা থেকে শুরু করে আত্নীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি, ধনী-গরীব, মিসকীন সবাই খেতে পারবেন। অনেকেই মনে করে থাকেন সন্তানের আকিকা দিলে মা-বাবা সে আকিকার মাংস খেতে পারবেন না। বরং সে মাংস শুধু পাড়াপ্রতিবেশী ও গরীব মিসকিনদের দিতে হবে। তবে এটি সম্পূর্ন ভুল একটি মাসআলা।
তাই যদি কারও ক্ষেত্রে এমনটি শুনে থাকেন যে আকিকার মাংস মা-বাবা খেতে পারবে না তাহলে এ তথ্যটি গ্রহন করবেন না। আকিকার গোশত বন্টন করবেন- নিজের জন্য রাখবেন, কিছু আত্নীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশিকে দিবেন এবং দরিদ্র মিসকিনদের দিবেন। এটি উত্তম তবে যদি কেউ মাংস রান্না করে দাওয়াত করে মানুষকে খাওয়ায় তাহলে সেটিও করতে পারবেন। এটিও প্রশংসনীয় একটি কাজ।
নিজের আকিকা নিজে দিতে পারবে
সন্তান জন্ম নেওয়ার সপ্তম দিনে সন্তানের আকিকা দেওয়া প্রথমে বাবার কর্তোব্য। এরপর বাবার সামার্থ্য না থাকলে পরিবারের অভিভাবক যে কেউ আকিকা করলে তা আদায় হয়ে যাবে। তবে অনেক সময় দেখা যায় অভিভাবক বিভিন্ন কারণে সন্তানের আকিকা দেয় না। সেক্ষেত্রে অনেকেই বড় হয়ে নিজের আকিকা নিজে দিতে চায়। তবে প্রশ্ন হলো নিজের আকিকা নিজে দিতে পারবে কি না। তো চলুন সঠিক তথ্য জেনে নিন নিজের আকিকা নিজে দিতে পারবেন কি না।
সন্তানের আকিকা যদি কোনো কারনে তার পিতা বা অভিভাবকেরা দিতে না পারে তাহলে নিজের আকিকা নিজে দিতে পারবে। কারণ হযরত আনাস রা. বলেন- রাসূল (সা.) নবুয়ত প্রাপ্তির পর নিজের আকিকা নিজে করেছেন; ফাতহুল বারী, ৯/৩৭০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস নং: ৬২০৩।
সুতরাং যদি সঙ্গত কোনো কারণে আপনার আকিকা ছোট বেলায় দেওয়া না হয়ে থাকে তাহলে পরবর্তীতে নিজের আকিকা নিজে দিলেও তা আদায় হয়ে যাবে।
আকিকার মাসআলা
ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী আমরা প্রত্যেক মুসলিম সন্তানের আকিকা করার ইচ্ছা পোষন করে থাকি। আকিকা জরুরি কিছু মাসআলা রয়েছে যেগুলো আকিকা দেওয়ার সময় আমাদের জানা জরুরি। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক আকিকার মাসআলা সম্পর্কে।
১. প্রথমে আমাদের জানতে হবে আকিকা কী? আকিকা হলো সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিনে মহান আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায়ে পশু জবাইয়ের প্রক্রিয়া। বিভিন্ন হাদিসে রাসুল (সা.) সন্তান জন্ম হওয়ার সাথে আকিকার বিষয়টি সম্পর্কিত করেছেন।
২. সন্তান জন্ম হওয়ার দিন থেকে শুরু করে সপ্তম দিনেই আকিকা করা সবথেকে উত্তম। আর কোনো কারণবশত সপ্তম দিনে আকিকা দিতে না পারলে ১৪ ও ২১তম দিনে দিয়ে দেওয়া ভালো। তবে পরবর্তীতে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে।
৩. আকিকা করা মুস্তাহাব, প্রত্যেক বাবার জন্য এটি কর্তব্য। পুত্র সন্তান হলে দুটি ছাগল এবং কন্যা সন্তান হলে একটি ছাগল দিয়ে আকিকা করতে হবে। তবে যাদের কোনোভাবেই সামার্থ্য নেয় তারা এর ব্যতিক্রম করতে পারে।
৪. আকিকার গোশত এক কথায় মা-বাবাসহ সবাই খেতে পারবেন। বন্টন করবেন কুরবানির গোশত বন্টনের নিয়ম অনুযায়ী।
আকিকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ন তথ্যগুলো আশা করি জেনে গেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই, সন্তান মহান আল্লাহর দেওয়া অনেক বড় একটি নেয়ামত। নবজাতক সন্তানের সকল প্রকার বিপদ দূর হয় আকিকার বরকতে। তাই আপনারা সবাই চেষ্টা করবেন সন্তানের আকিকা দেওয়ার। আর আকিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই রাসুল (সা.) এর দেখানো নির্দেশনা অনুযায়ী করতে হবে।