একটি শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন বাবা মায়ের জন্য এক আকাশ সমান ভালোবাসার পাশাপাশি এক ঝুড়ি দুশ্চিন্তাও নিয়ে আসে। বিশেষকরে যারা প্রথমবার বাবা মা হয়েছেন তারা বাচ্চা জন্মের পর করনীয় ও নবজাতক শিশুর যত্ন নিয়ে দারুন চিন্তায় পড়ে যান।
নিউ বর্ন হওয়া শিশুটির সব কিছুই খুব সতর্কতার সাথে করা উচিত। কারন আপনার সামান্য অসতর্কতার কারনে শিশুটির মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে।
একটি নিউবর্ন বেবি অনেক সংবেদনশীল ও দুর্বল হয় তাই তাকে কোলে নেয়া থেকে খাবার খাওয়ানো, সব কিছুই বিশেষ যত্নের সাথে করা উচিত। তাই নবজাতক জন্মের পর করনীয় ও প্রয়োজনীয় কিছু টিপস নিয়ে আজকে আলোচনা করবো।
নবজাতকের শারীরিক যত্ন
মায়ের গর্ভে গরম পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারনে নবজাতক ঠান্ডা ও তাপের প্রতি সংবেদনশীল হয়। তাই ঘরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে হবে। শিশুদের গরম রাখার জন্য কোমল ও আরামদায়ক কাপড়ে মুড়ে রাখুন। সরাসরি ফ্যান বা এসি–র বাতাস শিশুর দিকে যেন না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখুন। শিশুকে ধরার আগে হাত ধুয়ে নিন। অপরিষ্কার হাত শিশুর জন্য ক্ষতিকর। শিশুদের নখ ছোট রাখতে হবে এবং নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
এছাড়াও সন্তান জন্মের পর করনীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ হল নাভি শুকিয়ে পড়া পর্যন্ত শুকনো এবং নিয়মিত পরিষ্কার রাখা। তা না হলে নাভিতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতীত নাভিতে কোনো প্রকার লোশন বা তেল লাগাবেন না।
পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো
সন্তানকে জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত, যাকে “Colostrum” বলা হয়। এতে প্রচুর পুষ্টি ও রোগপ্রতিরোধক উপাদান থাকে। জন্মের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করুন, এতে শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে।
দুধ খাওয়ানোর সময় নতুন মায়েদের কিছুটা সতর্ক থাকা জরুরী তা না হলে শিশুর গলায় দুধ আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খাওয়ানোর সময় মাথা সামান্য উঁচু করে রাতে হবে যাতে শ্বাসনালীতে দুধ না ঢুকতে পারে।
শিশুকে দুধ খাওয়ানোর সময় দুই স্তন থেকেই দুধ খাওয়াতে হয়। এতে মায়ের স্তনে দুধ উৎপাদনের ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শিশুও পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়।
নিউবর্ন বাচ্চা সাধারণত নিতে ১৪ থেকে ১৭ এমনকি ২০ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটায়। কিন্তু বাচ্চাকে ২ থেকে ৩ ঘন্টা অন্তর দুধ খাওয়াতে হয়। তাই যখনি বাবুর ঘুম ভাঙবে তাকে দুধ দিতে হবে। তা না হলে পুষ্টির ঘাটতি হতে পারে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
শিশুর বৃদ্ধি সাধারণত ঘুমের মধ্যেই হয়, তাই নবজাতকের যত্ন যারা নিবেন তাদের ঘুমের বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। নবজাতককে সোজাভাবে চিত করে ঘুমাতে দিন। অন্তত প্রথম ছয় মাস পেটের উপর উপুড় হয়ে অথবা পাশ ফিরিয়ে শোওয়ানো উচিত নয় কেননা এতে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে পারে।
শিশু ঘুমানোর জন্য আলাদা ও সুরক্ষিত বিছানা ব্যবহার করুন, তবে খুব নরম বিছানা বা অতিরিক্ত বালিশ ব্যবহার এড়িয়ে চলুন। বেবি যেহেতু দুধ চুষে খেতে অভ্যস্ত তাই তাকে ঘুম পাড়াতে প্যাসিফায়ার ব্যবহার করতে পারেন। এতে তার দুগ্ধ পানের অনুভূত হওয়ায় ভালো ঘুম হয়।
শিশু যখন ঘুমাবে তখন তাকে নরম ও আরামদায়ক জামাকাপড় পড়াতে বলেন চিকিৎসকরা। এছাড়াও ঘরের তাপমাত্রা যেন খুব বেশি গরম অথবা খুব বেশি ঠান্ডা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
নবজাতকের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
শিশুর শারীরিক বিকাশের পাশাপশি মানসিক বিকাশের দিকেও বাবা মায়ের নজর দিতে হবে। হঠাত জোড়ে শব্দ বা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে শিশু ভয় পেয়ে যেতে পারে। তার সাথে নিয়মিত কথা বলুন, তাকে আদর করুন এবং সংস্পর্শে রাখুন, এটি তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক।
এছাড়া মাকেও শিশুর সামনে হাসিখুশি ও উৎফুল্ল থাকা উচিত। কেননা মা অবসাদে ভুগলে তা শিশুর মাঝেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা পরবর্তীতে শিশুর মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে।
নবজাতকের ত্বকের পরিচর্যা
নবজাতকের ত্বক অত্যন্ত নরম ও সংবেদনশীল। তাই প্রথম কয়েক দিন গরম পানিতে নয়, বরং হালকা কুসুম গরম পানিতে স্পঞ্জ দিয়ে পরিষ্কার করুন। ডায়াপার নিয়মিত পরিবর্তন করুন। দীর্ঘসময় ভেজা ডায়াপারে শিশু থাকলে র্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নবজাতক শিশুর যত্ন নেওয়ার সময় সতর্ক থাকা জরুরী। শিশুর হিসু ও পটি পরিষ্কার করার সময় নরম ওয়াইপার ব্যবহার করুন।
সম্ভব হলে প্রাকৃতিক তেলের (যেমন নারকেল তেল) হালকা মসাজ করুন, এটি ত্বক নরম রাখে এবং শিশুর ঘুমে সহায়তা করে।
নবজাতকের শারিরীক উন্নতি পর্যবেক্ষন
প্রথম কয়েক মাসে শিশুকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো উচিত এবং কোনো সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত শিশু ডাক্তারকে দেখান। শিশু সর্দি-কাশি, জ্বর বা ওজন না বাড়ার মতো সমস্যায় পড়লে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রতিটা শিশুই একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উপুড় হতে, বসতে ও দাঁড়াতে শিখে যায়। এই বিষয়গুলোও বাবা মাকে খেয়াল রাখতে হবে।
নিউবর্ন বেবিদের যত্ন নেওয়ার সময় তাদের টিকার বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। বাচ্চাকে নির্দিষ্ট সময়ে সব টিকা দিন। এটি শিশুকে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। জন্মের পর বিসিজি, হেপাটাইটিস বি, এবং পোলিওর টিকা সাধারণত প্রয়োজন হয়।
লেখকের শেষ বক্তব্য
নবজাতক জন্মের পর করনীয় বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল। এই টিপসগুলো নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সঠিক যত্নের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এগুলো শিশুর সুস্থ ও সুখী হয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।