ইসলামে ইমামের মর্যাদা অনেক। মসজিদে নামাজের নৃতৃত্ব যে ব্যাক্তি পালন করে থাকে, তিনিই ইমাম। তবে সব ব্যক্তি মসজিদের ইমাম হতে পারে না। ইমাম হওয়ার জন্য কিছু বৈশিষ্ট ও শর্ত, যিনি ইমাম হবেন তার মধ্যে থাকা লাগবে। সে বৈশিষ্ট ও শর্তগুলো আমরা আজকের আর্টিকেলে তুলে ধরবো।
মসজিদে ইমাম নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই সঠিক ইমাম নির্বাচন করতে হবে। তাই জানতে হবে কারা ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে। আমাদের আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্ন পড়লে, আপনিও জেনে জাবেন কারা ইমামতি করার যাগ্যতা রাখে। কারন আমরা আজকের আর্টিকেলে একজন ইমামের বৈশিষ্ট এবং ইমামের শর্ত সম্পর্কে আলোচনা করবো।
একজন ইমামের বৈশিষ্ট
ইসলাম ধর্মে নামাজ হলো মুসলমানদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। আর সে নামাজের দায়িত্ব পরিচালনা ইমাম করে থাকেন। জামাতে নামাজ আদায় করার সময় ইমামকে অনুসরন করে নামাজ আদায় করতে হয়। তাই একজন ইমামের মর্যাদা ইসলামে অনেকগুন রয়েছে। শুধু মসজিদে ইমামের মর্যাদা সীমাবদ্ধ নয়, সমাজেও তিনি মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যাক্তি। যে কেউ মসজিদের ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এমন কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে, যেগুলো ইমাম হতে একজন ব্যাক্তির মধ্যে থাকা আবশ্যক। চলুন জেনে নেওয়া যাক একজন ইমামের বৈশিষ্ট গুলো কি কি-
- ইমাম হওয়ার সবথেকে গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট হলো যিনি ভালোভাবে, শুদ্ধ করে কুরআন পড়তে পারেন। আর কুরআন মুখস্থ রাখতে হবে। আমাদের প্রিয় রাসুল সা. বলেছেন- তিন ব্যক্তি হলে ওদের মধ্যে একজন ইমামতি করবেন। আর ইমামতির বেশি হকদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে বেশি ভালো কুরআন পড়তে পারে। (মুসলিম, মিশকাত ১১১৮ নং)
- সালাত পড়ার নিয়মগুলো ভালোভাবে জানা, সঠিকভাবে সালাত পড়াতে পারা।
- সুন্নাহর শিক্ষা যার মধ্যে বেশি রয়েছে, সেই ইমামতি হতে পারবে।
- হারাম কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
- একজন ইমাম ব্যক্তিকে পবিত্র থাকতে হবে।
এসব ছাড়াও কিছু গুনবলী ইমাম হতে প্রয়োজন। জেনে নিন গুনাবলী কি কি-
- মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করা, বিনয় ও নম্রতার সাথে কথা বলা।
- সবসময় সৎ কাজের ওপর থাকা।
- আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা। মহান আল্লাহ তায়ালার দেয়া বিধানগুলো পালন করা।
- পাপ কাজ থেকে দূরে থাকা।
- ধৈর্যশীল হওয়া।
- ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান থাকা।
- মুসল্লিদের সুবিধা ও অসুবিধার দিকে নজর দেওয়া।
উপরের গুনাবলী একজন ইমাম সাহেবের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। কারন একজন ইমাম ব্যক্তির থেকে মানুষ দ্বীন ও চরিত্র শিখবে।
ইমামতির শর্ত কয়টি
ইমাম হতে হলে কিছু শর্ত রয়েছে, সে শর্তগুলো ইমাম নিয়োগে অবশ্যই থাকতে হবে। যখন ইমামের সে শর্তগুলো কোনো ব্যক্তির মধ্যে থাকবে, তখনি সে ব্যক্তি ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখবে। আর এ শর্তগুলো যার মধ্যে থাকবে না, সে ব্যক্তি ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। ইমাম বানাতে সে শর্তগুলোর আমাদের জেনে রাখা উচিত। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক ইমামের শর্তগুলোর সম্পর্কে।
- ইমাম হতে হলে অবশ্যই পুরুষ ব্যক্তিকে ইমাম হতে হবে। কোনো মহিলা ব্যক্তি ইমাম হতে পারবে না। মহিলা ব্যক্তির ইসলামে ইমাম হওয়া নিষিদ্ধ।
- ইমামতি যিনি করবেন অবশ্যই তাকে মুসলিম হতে হবে। কোনো অমুসলিম ব্যক্তি ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
- বালেগ হওয়া ইমামতির একটি শর্ত। কোনো নাবালক ইমাম হতে পারবে না।
- ইমামতি হতে হলে অবশ্যই বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে। কারণ পাগলের ইমামতি শুদ্ধ হয় না।
- প্রয়োজনীয় কেরাত পড়তে সক্ষম হওয়া। এজন্য কুরআন শুদ্ধভাবে মুখস্থ থাকতে হবে।
- নামাজ বিশুদ্ধভাবে পড়তে জানতে হবে। নামাজ সহিহ হওয়ার শর্তগুলো একজন ইমামকে অবশ্যই জানতে হবে।
- অপারগতা মুক্ত হওয়া। যেমন-নাক দিয়ে রক্ত ঝড়া, প্রসাব ঝরা, সবসময় বায়ু নির্গত হওয়া ইত্যাদি অপারগত ম্ক্তু হতে হবে।
উপরের বলা শর্তগুলো যদি কারও মধ্যে থাকে, তাহলে সে ইমাম হতে পারবে।
ইমামতি করার নিয়ম
সাধারণত ইমাম মসজিদে নামাজের দায়িত্ব পালন করে থাকলেও। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে অন্যদের ইমামতি করার দায়িত্ব পড়ে যায়। কোনো কারণে যদি ইমাম মসজিদে আসতে না পারে, কিংবা নামাজের মধ্যে ইমামের ওজু ভঙ্গ হলে এরম বিভিন্ন কারনে ইমাম নামাজ পড়াতে না পারলে, ইমামতির দায়িত্ব অন্য কাউকে দেওয়া হয়। তবে সবাই সে দায়িত্ব পালনে যোগ্যতা রাখে না। ইমাম হতে যে শর্তগুলো প্রয়োজন, সেগুলো তার মধ্যে থাকা লাগবে। হঠাৎ করে ইমামের দায়িত্ব কেউ নিতে চাইলে, তখন অনেকেই বুঝতে পারে না, ইমামতি কিভাবে করতে হয়। আসলে নিয়মিত ইমামতির দায়িত্ব পালন না করে থাকলে এমন মনে হয়। তাই ইমামতি করার নিয়মগুলো জেনে রাখা ভালো।
- ইমামতি করতে প্রথমে মনে মনে নিয়ত করবে যে তিনি ইমামতি করবেন।
- এরপর তাকবির দেওয়ার আগে মুসল্লিদের কাতার সোজা করতে বলতে হবে, সামনের কাতার আগে পূরন করতে বলতে হবে এবং কাতারে যেন কোনো ফাঁকা না থাকে ইমামকে সেটা নির্দেশ দিতে হবে।
- নামাজ শুরুর প্রথম রাকাত একটু লম্বা করতে হবে, যাতে কেই কোনো কারনে পিছে আসলে রাকাতটি যাতে পেয়ে যায়।
- ইমামতি করতে হলে কুরআন পাঠে অভিজ্ঞ থাকতে হবে। ইমামের আলাদা কোনো দুয়া নেই, নামাজের নিয়মেই নামাজ পড়াতে হবে।
- ইমাম নিজের জন্য শুধু দোয়া করবেনা, নিজের ও সবার জন্য একসাথে যেন দুয়া হয় সেজন্য বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে দোয়া করতে হবে।
- নামাজ শেষ হলে মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসতে হবে। এমনটি আমাদের রাসূল সা. করতেন।
- ফরজ নামাজ শেষ হয়ে গেলে, যে স্থানে ফরজ নামাজ আদায় হয়েছে সে স্থান থেকে সরে ইমামসহ সবাইকে অন্য স্থানে সুন্নাহ পড়তে হবে।
- যিনি ইমামতি করবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যে পেছনে মুক্তাদিগন রয়েছে। তাই আওয়াজ করে তাকবির দিতে হবে, যাতে তারা শুনতে পায়।
- তাড়াহুড়া করে সালাত আদায় করা যাবে না। মুক্তাদিগন যাতে ঠিকভাবে সালাত বুঝতে পারে সেভাবে সালাত আদায় করতে হবে।
- মুসল্লিদের কষ্ট হয় এমনভাবে লম্বা রুকু ও সেজদা করা যাবে না।
- সবসময় ইমামকে খেয়াল রাখতে হবে যে তিনি পেছনের মুক্তাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সে অনুযায়ী তাকে সালাত আদায় করাতে হবে।
ইমামের অযোগ্য ব্যক্তি কারা
যে কেই ইমাম হতে পারে না, একজন অধিক গুনসম্পন্ন ব্যক্তিকে ইমাম নিযুক্ত করা অপরিহার্য। যোগ্য ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করলে সমাজে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি আসে এবং আখিরাত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়। তাই ইমাম সতর্কতার সাথে মসজিদে নিযুক্ত করতে হবে। এমন কিছু ব্যাক্তি আছে যারা ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। ইমাম নিযুক্ত করতে সেসব ব্যক্তিকে চিনে রাখা জরুরি। তো চলুন জেনে নেওয়া যাক ইমামের অযোগ্য ব্যক্তি কারা।
- যারা হারাম কাজ করে, হারাম ভক্ষন করে এক কথায় হারামখোরেরা ইমাম হওয়ার জন্য অযোগ্য ব্যক্তি।
- যাদের শরীরে তাক্কওয়ার পোশাক থাকে না, কাপড় পরিধান করে টাখনুর নীচে তারা ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
- সুদ-ঘুষের সাথে জড়িত যে ব্যক্তি, সে ব্যক্তি ইমাম হতে পারবে না।
- যে ব্যক্তি কুরআন শুদ্ধভাবে জানে না, সে ব্যক্তি ইমামের অযোগ্য ব্যক্তি। শুদ্ধভাবে কুরআন না জানলে নামাজও শুদ্ধ হয় না, তাই এ ধরনের ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে রাখা যাবে না।
- পাগলেরা ইমামের অযোগ্য ব্যক্তি।
- যে ব্যক্তি সবসময় পাক পবিত্র থাকে না, সে ব্যক্তি ইমাম হওয়ার জন্য যোগ্য না।
- অন্ধ ব্যক্তির ইমামতি মাকরুহ। তবে মসজিদে যারা উপস্থিত তাদের সবার মধ্যে অন্ধ ব্যক্তিটি যদি বেশি কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে অভিজ্ঞ হন তবে সমস্যা নেই।
- ধর্মীয় জ্ঞানহীন ব্যাক্তির ইমামতি মাকরুহ।
- বিদআতির ইমামতি মাকরুহ।
- মুক্তাদীদরা যে ব্যক্তিকে ইমাম হওয়ায় দুর্বল মনে করবে, এ ধরনের ব্যক্তিদের ইমাম হওয়া মাকরুহ।
যোগ্যহীন ব্যক্তিরা নিজের চাকুরি টিকিয়ে রাখতে ইসলামের নামে মিথ্যা প্রচার করে। খুৎবার নামে মিথ্যা গল্প বলে এবং জাহান্নামের কথা তারা মনে রাখে না। এর ফলে মসজিদে যারা নামাজ পড়বে সঠিক কিছু ইমামের থেকে শিখতে পারবে না। তাই যে ব্যক্তিরা ইমাম হওয়ার যোগ্যতা রাখে না, সে ব্যক্তিকে ইমামতির দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়।
কোন ইমামের পিছনে নামাজ হবে না
ইমাম হলো ইসলামের মর্যাদাসম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ন একজন ব্যক্তি। তাই মন গড়ানো যাকে ইচ্ছা ইমাম বানানো যাবে না। কারন যে কেই ব্যক্তি ইমাম হয়ে গেল, তার পিছনে নামাজ আদায় করে নিলেন। কিন্তু সব ইমামের পিছনে নামাজ হবে না। তাই ভালোভাবে বুঝে মসজিদে ইমাম নিযুক্ত করতে হবে।
ইমাম যদি পুরুষ না হয়ে মহিলা হয়, তাহলে সে ইমামতির নামাজ হবে না। ইমাম অবশ্যই একজন পুরুষকে হতে হবে। কারন ইসলামের গুরত্বপূর্ন ইবাদত হলো নামাজ, আর মহিলারা ইমামতি করায় সে নামাজ যদি নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে পরকালে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।
মুশরিক ও বিদআতী লোক যদি ইমামে নিযুক্ত হয়, তাহলে সে ইমামের পিছনের নামাজ হবে না। যে ব্যক্তি মাযার বিশ্বাস করে, আল্লাহ ব্যতিত মাযারে সেজদা করে, মানত করে, মাযারে সন্তান চায়, যে ব্যক্তি নিজেকে গায়বী দাবী করে, লোকের ভবিষ্যৎ বলে মিথ্যা প্রচার করে, যাদু করে, এ ধরনের ব্যক্তির ইমামতি শুদ্ধ হয় না। এমন অনেক বিদআতি আছে যেগুলো করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়। সে ধরনের বিদআতি যদি ইমামে নিযুক্ত ব্যক্তি করে থাকে, তাহলে সে ইমামের পেছনে কোনো ভাবেই নামাজ হবে না।
যে ইমাম কুরআন শুদ্ধভাবে পড়তে পারে না, এমন ভাবে কুরআন পড়ে যার অর্থ পাল্টে যায়। এরকম ব্যক্তি যদি মসজিদের ইমাম হয়, তাহলে সে ইমাম এর পিছনে নামাজ হবে না।
মুক্তাদীদের অপচ্ছন্দ এমন ইমামের নামাজ আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন না। তবে ব্যক্তিগত কারনে অপচ্ছন্দ করলে সেটা মুক্তাদির দোষ। কিন্তু চরিত্রগত ও শিক্ষাগত কোন কারণে ইমামকে অপচ্ছন্দ করলে সে নামাজ হবে না।
যে ইমামের সবসময় প্রসাব ঝরে, পাক পবিত্র থাকে না। এটা জানা সত্ত্বেও যদি সে ইমামের পেছনে দাড়িয়ে নামাজ পড়া হয়, যারা তার পেছনে নামাজ পড়ে তাদের নামাজ হবে না।
উপরের আলোচিত ব্যক্তিগুলো যদি ইমাম হয় এবং জেনে শুনে যদি মুক্তাদীরা তার পেছনে নামাজ আদায় করে তাহলে সে নামাজ হবে না। তাই একজন ইমাম নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই ভালোভাবে বিবেচনা করে সঠিক ইমাম বাছায় করতে হবে। কুরআন ও হাদীসে অভিজ্ঞ, তাক্কওয়াশীল ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে নিযুক্ত করতে হবে।
লেখকের শেষ বক্তব্য
একজন ইমামের বৈশিষ্ট – ইমামের শর্ত কয়টি সে সম্পর্কে আজকের এই ব্লগে সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি একজন ইমামের বৈশিষ্ট – ইমামের শর্ত কয়টি সে সম্পর্কে আপনি বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। যদি আপনি এই ধরনের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ব্লগ পোস্ট নিয়মিত পড়তে চান তাহলে আপনাকে প্রতিনিয়ত আমাদের এই ওয়েবসাইট ফলো করতে হবে।